আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। ঘাড়ে ভূত চাপার মতো হঠাত্ করেই আমার সাধ চাপল বই বের করার। শুরু করলাম তদবির। আমাদের পাশের গ্রামের এক লোকের বেশ বড় একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকায়। এই লোকের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে একদিন তাকে ফোন করলাম। বললাম বই প্রকাশের ইচ্ছের কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো আমি কী করি। যেই না বললাম আমি ইন্টারে পড়ি, সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে গেল। আমি ভাবলাম লাইনে কোনো সমস্যা তাই আবার ফোন করলাম। একটু আগে যে কণ্ঠটিকে বেশ গুরুগম্ভীর এবং ভদ্রসদ্র মনে হয়েছিল, সেই কণ্ঠটিই খেঁকিয়ে উঠল এবার—ফোন কেটে দিয়েছি আবার ফোন কিসের! আমি মৃদু ভয় পেয়ে গিয়ে বললাম—না, মানে ওই যে বই প্রকাশের কথা বলেছিলাম। এবার মনে হয় লোকটার খেঁকানো ভিন্ন মাত্রা পেল—এই ছেলে তুমি কি করে ভাবলে তোমার মতো ইন্টারের একটা ছেলের বই আমি প্রকাশ করব? তুমি জান আমি কত বড় মাপের প্রকাশক? জান কত বড় বড় লেখক আমার পেছনে ঘুরঘুর করে বই প্রকাশের জন্য? এবার মনে হয় আমি একটু সাহস পেলাম। বললাম—যেহেতু আপনার পেছনে লেখকরা ঘুরঘুর করে, তার মানে আপনার গাড়ি নেই, তাই তো? গাড়ি থাকলে তো ঘুরঘুর করতে পারত না। পেছনে দৌড়াতে হতো। এবার বিকট আওয়াজ করে ফোন রেখে দেয়া হলো ওপাশ থেকে। ফোন রেখে দেয়ার এই আওয়াজে আমার কানের পর্দা বেশ আঘাতপ্রাপ্ত হলো। আঘাতপ্রাপ্ত হলো আমার মনও। একবার তো মনেই হলো আমার মনটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেছে। আমি মনের এই টুকরোগুলোকে একত্রিত করে আবার নতুন আশায় বুক বাঁধলাম। তবে বুক এত শক্ত করে বাঁধলাম যে, মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে। আর দম বন্ধ হওয়ার প্রথম প্রমাণ পেলাম বাবার কাছে গিয়ে। বাবার কাছে গিয়েছিলাম মূলত টাকার জন্য। কারণ, এর মধ্যে আমি জেনে গিয়েছিলাম প্রথম বই প্রকাশ করতে টাকা লাগবেই। টাকার অ্যামাউন্টটাও জেনে নিয়েছিলাম একজনের কাছ থেকে। তারপর যেই না টাকাটা চাইলাম, বাবা হাত বাড়ালেন ডান দিকে। আমি ভাবলাম তিনি বুঝি আলমারি খোলার জন্য চাবি নিচ্ছেন। কিন্তু পাশেই যে একটা বাঁশের গোড়া ছিল, তা আর খেয়াল করিনি। খেয়াল করলাম যখন তিনি এটা হাতে নিয়ে লাফ দিয়ে আমার সামনে এসে পড়লেন। আমি বাংলা ছবির নায়িকাদের মতো বাঁচাও বলে একটা চিত্কার দিয়ে শুরু করলাম দৌড়। বাবাও আমার পেছনে পেছনে দৌড়াতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন—পড়ালেখার নাম-গন্ধ নেই, উনি বই বের করবেন। বের করাচ্ছি বই। আমি দৌড়াচ্ছি, বাবাও দৌড়াচ্ছেন। দৌড়াতে দৌড়াতে আমার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল, বাবা শেষ বয়সে এত অ্যানার্জি কোত্থেকে পেলেন, কীভাবে পেলেন। আমি খালি হাতে দৌড়াচ্ছি, আর বাবা দৌড়াচ্ছেন বাঁশের গোড়া নিয়ে। বাঁশের গোড়াটার ওজন কম করে হলেও পাঁচ কেজি হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, এরপর বাবার সঙ্গে যখন সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে, তখন আমি তাকে এই অ্যানার্জির গোপন রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব। সম্ভব হলে তার কথাগুলো রেকর্ড করে রাখব। ভবিষ্যতে যদি কেউ কখনও এনার্জি ড্রিংকের বিজ্ঞাপন করতে চায়, আমি মডেল হিসেবে বাবার নাম প্রস্তাব করব। যাক, দৌড়াতে দৌড়াতে যখন আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন কী মনে করে যেন বাবা দৌড়ানি বন্ধ করলেন। তিনি চলে এলেন বাড়িতে, আমি মাঠে বসে হাঁপাতে লাগলাম। রাতে বাড়ি ফিরে বাবার চেহারা দেখে আমি অবাক হলাম। শতভাগ পজিটিভ চেহারা। এক সময় তিনি ডেকে নিয়ে আমার হাতে পনের হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেন। আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তখনও আমি চোখ বড় বড় করে খেয়াল করছিলাম, তিনি বাঁশের গোড়ার জন্য হাত বাড়ান কিনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন তা না করে টাকা দিলেন তখন একজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম আমার অনুপস্থিতিতে মা তাকে সোজা করে ফেলেছেন। আমি এই টাকা নিয়ে পরদিনই মাঠে নেমে পড়লাম। আরেক প্রকাশক খোঁজ করে টাকার বিনিময়ে পাঁচশ কপি বই প্রকাশ করেই ফেললাম। বই প্রকাশ হওয়ার দিন কয়েক আগে থেকেই যখন সবার কাছে বলছিলাম আমার বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, তখন আমার প্রতি সবার সে কী আশ্বাস! আমার বই একেকজন কমপক্ষে দশ কপি করে কিনবে। কেউ আবার এমনও বলল—বই পাঁচশ না, বরং পাঁচ হাজার কপি ছাপাতে। নইলে নাকি সবাই বই পাবে না। একেকজন দশ কপি করে কিনলে যা হয় আর কি। যথাসময়ে বই প্রকাশিত হলো। আমি নিজ উদ্যোগে এলাকার সব লাইব্রেরিতে বই দিলাম। তারপর অপেক্ষা করতে লাগলাম কবে এসব লাইব্রেরির মালিকরা আমাকে খবর পাঠাবে টাকা নেয়ার জন্য। আর বলতে আরও বই দিতে। মাস ছয়েক অপেক্ষার পরও যখন কোনো খবর টবর হলো না তখন একদিন গেলাম লাইব্রেরির দিকে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম বেস্ট সেলার বইয়ের লেখক হিসেবে তারা আমাকে এমন জোরে জড়িয়ে ধরবে যে, আমি তাদের বুক থেকে সরতেই পারলাম না। তারপর দোকানে যত রকমের খাবার পাওয়া যায় সবই এনে খাওয়াবে। একটা লাইব্রেরির দরজায় পা রাখতেই আমার খানিকটা খটকা লেগে গেল। কারণ মালিকের মুখ হেভি কালো। প্রথম ভাবলাম অনেকদিন হয়তো তিনি রং ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করেন না তাই কালো দেখাচ্ছে। একটু পরেই বুঝে গেলাম পুরো ঘটনা। এই কয় মাসে নাকি তার দোকান থেকে তিন কপি বই বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য লাইব্রেরির খবরও একই রকম। এই একই রকম খবরের মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু খবরও পাওয়া গেল। তা হলো—বেশ কটি লাইব্রেরিতে এক কপিও বিক্রি হয়নি। এর মধ্যে এক বিক্রেতা আমাকে বলল—বই এখানে সেখানে না দিয়ে একুশে বইমেলায় ছাড়ুন। একমাস পরেই ছিল বইমেলা। প্রকাশককে বলে কয়ে মেলায় তুললাম বই। প্রকাশক বলল কিছু বিজ্ঞাপন দিন, নইলে বই চলবে না। কিছু পোস্টারিংও করতে পারেন। আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম বিজ্ঞাপনের খরচের তুলনায় পোস্টারিংয়ের খরচ অনেক কম। একদিন রাতে কয়েক বন্ধুকে নিয়ে বের হলাম পোস্টার লাগাতে। এক দেয়ালে পোস্টার লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে চারজন লোক এসে ধরে ফেলল আমাদের। পরে জানতে পারলাম ‘পোস্টার লাগানো নিষেধ’ লেখা দেয়ালে নাকি আমরা পোস্টার লাগিয়েছি। অন্ধকারের জন্য আমরা লেখাটা দেখতে পাইনি। লোকগুলো আমাদের ধরে নিয়ে গেল তাদের মনিবের কাছে। হাবভাব দেখে বুঝলাম, আমাদের পুলিশে দেয়া হবে। মনিব থানায় ফোন করার আগে মুখ ভেংচে আমাদের জিজ্ঞেস করল—এই বেটারা, দেয়ালে ‘পোস্টার লাগানো নিষেধ’ লেখা আছে দেখতে পাসনি? তাহলে কোন সাহসে পোস্টার লাগিয়েছিস! হঠাত্ একটা বুদ্ধি এলো আমার মাথায়। বললাম—চাচা, আমরা লেখাটা দেখলেও পড়তে পারিনি। আমরা সবাই অশিক্ষিত তো! ওই প্রকাশনার কর্মচারী।
সূত্র : আমারদেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন