স্কুলে যখন পড়তাম তখন প্রত্যেক বছরই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান মন ভরে উপভোগ করতাম। সবচেয়ে মজা লাগত শিক্ষকদের দড়ি টানাটানি খেলাটা। দড়ি টানাটানি খেলায় শুধু শিক্ষকরাই নয়, স্কুল কমিটির সদস্যরাও উপস্থিত থাকতেন। প্রথমে শিক্ষক ও কমিটির লোকজনকে দুই ভাগে ভাগ করা হতো, তারপর শুরু হতো দড়ি টানাটানি। দল ভাগ করা নিয়ে ঘটে যেত অনেক কাণ্ড। বিপত্তিটা লাগত আমাদের প্রধান শিক্ষককে নিয়ে, কারণ ওনার ভুঁড়ি বড় হওয়ায় সবাই দড়ি টানাটানির আগে ওনাকে নিয়েই টানাটানি করত। ওনাকে যে দলে রাখা হতো, সব সময় সে দলই দড়ি টানাটানিতে জিতে যেত। খেলা শুরু হলে দু’পক্ষ থেকেই টানাটানি শুরু হতো। একপর্যায়ে হেড স্যারের পক্ষ কষে টান মারলে বিপক্ষ দলের সদস্যরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলাফল, হেড স্যারের দলই জয়ী।
কোনো এক বাংলা সিনেমায় দেখেছি স্বামী নিয়ে দুই নায়িকা অর্থাত্ দুই বউকে টানাটানি করতে, যদিও শেষে প্রমাণিত হয় স্বামীর আসল বউ কে, তবুও টানাটানি নিয়ে তুলকালাম ঘটে যায়। পাঠক, এতক্ষণ দড়ি টানাটানি ও স্বামী টানাটানির কথা বলছি, এবার আসি বিল টানাটানি প্রসঙ্গে। কিছুদিন থেকেই শুরু হয়েছে আড়িয়ল বিল নিয়ে টানাটানি। রক্তের বিনিময়ে হলেও সেখানকার মানুষ রক্ষা করতে চায় তাদের প্রাণের বিল। অন্যদিকে সরকার সেখানে বিমান উড়াতে চাচ্ছে অর্থাত্ এয়ারপোর্ট বানাতে চাচ্ছে। আমাদের হেড স্যারের ভুঁড়ির কারণে দড়ি টানাটানিতে ওনার দলই জিতে যেত, কিন্তু আড়িয়ল বিল নিয়ে যেভাবে টানাটানি চলছে তাতে শেষতক কারা জেতে, বলা যাচ্ছে না। আড়িয়লবাসী আন্দোলন করছে আর পুলিশ রুখে দিচ্ছে, আন্দোলন রুখতে গিয়ে ঘটছে নিহত আহত হওয়ার মত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
অবশ্য কারও কারও রক্ত ঝরাতে আবার কারও কারো খুব মজা লাগে। এই ধরুন মশা ও আমাদের মধ্যে এত তিক্ত সম্পর্ক যে, আমরা কেউই কাউকে ছাড় দিতে রাজি না। আমাদের রক্ত চুষে পেট ভরাতে পারলে মশা বাহিনীর আনন্দের শেষ থাকে না। আবার মশাদের কষে থাপ্পড় মেরে রক্ত ঝরাতে পারলে আমরা খিলখিলিয়ে দাঁত বের করে হাসি। সোজা কথায় বলা যায় কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। এবার বলছি মশাবিষয়ক একটা গল্প—
এক লোক মশারি টাঙানোর পর মশারির ভেতরে বসে বসে মশা খুঁজছে, বাইরে মশক দলের এক সদস্য উত্তেজিত হয়ে উঠল।
—মশারির ভেতর তো খুঁজবাই, সাহস থাকলে মশারি ছাড়া ঘুমাও দেখি!
—ক্যান চান্দু রক্ত চুষতে বুঝি খুব টেস্ট লাগে?
—চুপ করো মিয়া, তোমরা ভীতু নাম্বার ওয়ান। সামান্য আমাদের ভয়ে মশারি টাঙাও অথচ গরু-ছাগল পর্যন্ত রাতে মশারি ছাড়া ঘুমায়।
—ভীতু কইলি ক্যান, বের হলে কিন্তু এক থাপ্পড়ে সাইজ কইরা দিমু?
—মশারির ভেতর লাফাস ক্যান, সাহস থাকলে বাইরে আয়। বাইরে এসে আমাকে আঘাত করতে চাইলেই আমাদের গোয়েন্দা টিম ভেতরে ঢুকে পড়বে।
—হ আমি বের হমু আর তোমরা চুপিচুপি আমার মশারির জায়গা দখল করবা, প্রয়োজনে রক্ত দেব তবুও মশারির ভেতর থেকে বের হব না।
পাঠক, যুগে যুগে মশা ও আমাদের মধ্যে যে তিক্ত সম্পর্ক, এ সম্পর্ক আজীবনই নিম পাতার মতো তিতা থাকবে। কারণ, আমরা মশারি টাঙিয়ে একটু নাকে তেল দিয়ে ঘুমাব এটা মশার সহ্য হয় না। তারা মশারির ভেতর জবরদখল করার অপচেষ্টা চালায়। আবার মশা একটু খেয়ে-দেয়ে বাঁচুক এটা আমরা চাই না। যদি চাইতাম তবে থাপ্পড় মেরে রক্তাক্ত করে তাদের আহত কিংবা নিহত করতাম না। এই তিক্ত সম্পর্কের মতো এখন তিক্ত হয়ে উঠেছে আড়িয়লবাসী ও সরকারের সম্পর্ক। আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যে কাটছে তাদের জীবন। রক্ত দেবে তবুও তারা আড়িয়ল বিলকে এয়ারপোর্ট বানাতে দেবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত আন্দোলনের পরও যেহেতু এ বিল টানাটানির শেষ হচ্ছে না সেহেতু পুলিশ ও আড়িয়লবাসীর রক্ত কি ঝরতেই থাকবে ?
এ তিক্ত সম্পর্ক মশা ও আমাদের সম্পর্কের মতো দীর্ঘস্থায়ী না হোক, এটাই আমাদের কাম্য। দড়ি টানাটানি যেমন কিছুক্ষণ চলে থেমে যায় আবার স্বামী টানাটানিও যেমন এক পর্যায়ে স্থির হয়ে থেমে যায়, তেমন আড়িয়ল বিল টানাটানিও থেমে যাক।
সূত্র : আমার দেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন