এক বালিকার সঙ্গে অনেক দূর যাওয়ার কথা ছিল। চাণক্য সেনের পুত্র পিতাকে বইটি পড়তে দিয়েছিলাম। সেই বই পড়ে বালিকার পিতাই মুগ্ধ হয়ে গেল। আমার কাছ থেকে কত বই যে পড়তে নিয়েছিলেন! সেই বই একটাও আর ফেরত পাইনি, মেয়েটাকেও দেননি।
লেখাটা আসলে এতটুকুই। এই গল্পে বালিকা আছে, ভিলেন আছে, প্রেম আছে, বিরহও আছে। কিন্তু এইটুকু গল্পে তো পৃষ্ঠা ভরবে না। আরও বড় গল্প লাগবে। তাহলে আরেকটা গল্প বলি। স্মৃতিকথা ধরনের গল্প।
পাঠক হিসেবে আমি সর্বগ্রাসী। চোখ খোলার পর থেকেই আমার সঙ্গে বইয়ের বসবাস। আমার মায়ের ছিল বইয়ের একটা সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালায় বেশির ভাগই ছিল নিমাই, নিহাররঞ্জন, ফাল্গুনী আর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। আমার ফুফাতো ভাই তখন আমাদের সঙ্গে থাকে। তার থাকার মেয়াদ যত বাড়তে লাগল, মায়ের বইয়ের সংগ্রহ তত ছোট হতে লাগল। আর পাশের বাসার মিলি আপার বই পড়ার নেশা তত বাড়তে লাগল। সেই যুগে প্রেমে পতন ঘটাতে বইয়ের বড় ভূমিকা ছিল।
মায়ের বই বেহাত হওয়ার প্রতিশোধ নিয়েছিলাম আরও প্রায় ১০ বছর পর। চাচা মারা যাওয়ায় চাচাতো ভাই পান্না ভাই তখন গ্রাম থেকে শহরে, আমাদের বাসায়। সেই যুগে গ্রাম থেকে এলেও মেয়েরা প্রেমে পড়ত। এই নিয়ম মেনে পান্না ভাইয়ের প্রেমে পড়ল পাশের বাসার লিপি আপা। লিপি আপাদের বই সংগ্রহশালাটি বিশাল। আমি সুযোগের অপচয় করলাম না। বই আনা ও ফেরত দেওয়ার মধ্যে অসংখ্যবার সিস্টেম লস হতে লাগল। আশাপূর্ণার প্রথম প্রতিশ্রুতি এখনো আমার শেলফে শোভা পায়।
এটা আসলে একটা বিরহের গল্প। পান্না ভাইয়ের বউয়ের নাম লিপি না। এই বিশাল বিরহপূর্ণ প্রেমকাহিনির মধ্যে কেবল আমারই লাভ (মুনাফা অর্থে) হয়েছিল।
এবার একটা ঐতিহাসিক প্রেম-বিরহের গল্প। নাতি নানাকে বই পড়তে দেখে জানতে চাইল, নানা, তুমি কী বই পড়ছো?
নানা বলল, ইতিহাসের বই।
নাতি বলল, মিথ্যে কথা। তুমি একটা বড়দের প্রেমের উপন্যাস পড়ছো।
এবার নানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওটা তো আমার জন্য ইতিহাসই, নানাভাই।
২.
এবার বই লেখার গল্প। কেউ বই যদি না-ই লিখবে, তাহলে পড়ব কী? বড়রা আফসোস করে বলে, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না। কিন্তু বইমেলায় যে পরিমাণ বই প্রকাশিত হয় এবং বিক্রি হয়, তাতে কথাটি ধোপে টেকে না। সুতরাং নতুন নতুন লেখক তৈরি হচ্ছে। এখন তো নতুন লেখক তৈরির নানা সুযোগ। একজন নতুন লেখকের গল্প বলি।
তাঁর সঙ্গে দেখা এক সেমিনারে। পরিচয় হতেই জানালেন তিনিও লেখক। জানতে চাইলাম, কোথায় লেখেন।
—ফ্রিল্যান্স।
—কোন কোন পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে লেখেন।
—ইন ফ্যাক্ট ইন্টারনেটে।
এখন তো ইন্টারনেট ব্লগের মতো লেখালেখির নানা মাধ্যম হয়েছে। খুশি হয়ে জানতে চাইলাম, সেখানে কোথায়?
—অ্যাজ অ্যা ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, আমি বাংলায় লিখি না, ইংলিশে।
—তা কোন সাইটে বা ফোরামে বা ব্লগে লিখছেন?
মেয়েটি উত্তর দেয়—ফেসবুকে।
তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ-টাইপ আয়োজকেরা এসব লেখকদের দিকে এবার একটু তাকাতে পারেন। তবে তার আগে মার্ক টোয়েনের সেই পুরোনো গল্পটা আবার বলা যেতে পারে।
একদিন একজন এসে মার্ক টোয়েনকে এক লেখকের নতুন বই বের হওয়ার খবর দিয়ে জানতে চাইল, বইটা পড়েছেন?
মার্ক টোয়েন বললেন, হ্যাঁ, দেখেছি।
সেই একজন এবার আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, বইটা কেমন?
মার্ক টোয়েন বললেন, সত্যি বলতে কি, বইটা বন্ধ করলে আর খোলা যায় না।
৩.
বই পড়ার গল্প অনেক হলো। এবার বই পাওয়ার গল্প। বই পড়তে এসে ফেরত না দেওয়া পুরোনো তরিকা। সেই মার্ক টোয়েনের আমল থেকেই। তবে বই মেরে বইয়ের শেলফ ভরা যায় না। বই কিনতে হয়। আর বই কেনার সবচেয়ে ভালো জায়গা বইমেলা। আরও কম বয়সে আমার যখন বুদ্ধি বেশি ছিল, তখন বই পাওয়ার একটা উপায় বের করেছিলাম। কপিরাইটের এই যুগেও সেই আইডিয়াটি এখন ফ্রি বলা যেতে পারে।
আমার বাসায় একটা নোটিশ বোর্ড ছিল। সেই নোটিশ বোর্ডে প্রতিদিন জনগুরুত্বপূর্ণ নানা ধরনের নোটিশ টাঙাতাম। যেমন, একদিন হয়তো নোটিশ বোর্ডে ঝুলল, ‘আজকের রান্না ভালো হয়নি, ভাত ছিল ভর্তা’, আরেক দিন হয়তো বিরিয়ানি খাওয়ার অনুরোধের নোটিশ। এক ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে নোটিশ বোর্ডের সর্বোত্তম ব্যবহার করেছিলাম। সামনেই ছিল জন্মদিন। তাই বইমেলা ঘুরে ঘুরে পছন্দের বইগুলোর একটি তালিকা করে ঝুলিয়ে দিলাম নোটিশ বোর্ডে। নিচে লিখলাম, ‘এই বইগুলো আমার নেই। আমার জন্মদিনে এগুলো দিলেই বেশি খুশি হব।’ টার্গেট ছিল মামা, খালু, চাচা ধরনের মানুষেরা। এমন নয় যে আগের জন্মদিনে তারা আমাকে কিছু দিয়েছিল। কিন্তু এইবার পড়ল ফাঁপরে। চক্ষুলজ্জা বলে একটা ব্যাপার আছে। সেবার আমি অনেক বই পেয়েছিলাম।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। সুতরাং, সাবধান! যে কেউ বই না দিয়ে ইন্টারনেটের একটা লিংক বা ওয়েবসাইটের ঠিকানা ধরিয়ে দিতে পারে। আজকাল সবকিছুই নেটে পাওয়া যায়।
ভাইব্রাদার ভাষা, এফএম ভাষার পর নতুন এসেছে ব্লগের ভাষা। সেই ভাষায় বললে বলতে হয়, নেটে বই পড়ে মাইনষে!
লেখাটা আসলে এতটুকুই। এই গল্পে বালিকা আছে, ভিলেন আছে, প্রেম আছে, বিরহও আছে। কিন্তু এইটুকু গল্পে তো পৃষ্ঠা ভরবে না। আরও বড় গল্প লাগবে। তাহলে আরেকটা গল্প বলি। স্মৃতিকথা ধরনের গল্প।
পাঠক হিসেবে আমি সর্বগ্রাসী। চোখ খোলার পর থেকেই আমার সঙ্গে বইয়ের বসবাস। আমার মায়ের ছিল বইয়ের একটা সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালায় বেশির ভাগই ছিল নিমাই, নিহাররঞ্জন, ফাল্গুনী আর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। আমার ফুফাতো ভাই তখন আমাদের সঙ্গে থাকে। তার থাকার মেয়াদ যত বাড়তে লাগল, মায়ের বইয়ের সংগ্রহ তত ছোট হতে লাগল। আর পাশের বাসার মিলি আপার বই পড়ার নেশা তত বাড়তে লাগল। সেই যুগে প্রেমে পতন ঘটাতে বইয়ের বড় ভূমিকা ছিল।
মায়ের বই বেহাত হওয়ার প্রতিশোধ নিয়েছিলাম আরও প্রায় ১০ বছর পর। চাচা মারা যাওয়ায় চাচাতো ভাই পান্না ভাই তখন গ্রাম থেকে শহরে, আমাদের বাসায়। সেই যুগে গ্রাম থেকে এলেও মেয়েরা প্রেমে পড়ত। এই নিয়ম মেনে পান্না ভাইয়ের প্রেমে পড়ল পাশের বাসার লিপি আপা। লিপি আপাদের বই সংগ্রহশালাটি বিশাল। আমি সুযোগের অপচয় করলাম না। বই আনা ও ফেরত দেওয়ার মধ্যে অসংখ্যবার সিস্টেম লস হতে লাগল। আশাপূর্ণার প্রথম প্রতিশ্রুতি এখনো আমার শেলফে শোভা পায়।
এটা আসলে একটা বিরহের গল্প। পান্না ভাইয়ের বউয়ের নাম লিপি না। এই বিশাল বিরহপূর্ণ প্রেমকাহিনির মধ্যে কেবল আমারই লাভ (মুনাফা অর্থে) হয়েছিল।
এবার একটা ঐতিহাসিক প্রেম-বিরহের গল্প। নাতি নানাকে বই পড়তে দেখে জানতে চাইল, নানা, তুমি কী বই পড়ছো?
নানা বলল, ইতিহাসের বই।
নাতি বলল, মিথ্যে কথা। তুমি একটা বড়দের প্রেমের উপন্যাস পড়ছো।
এবার নানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওটা তো আমার জন্য ইতিহাসই, নানাভাই।
২.
এবার বই লেখার গল্প। কেউ বই যদি না-ই লিখবে, তাহলে পড়ব কী? বড়রা আফসোস করে বলে, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না। কিন্তু বইমেলায় যে পরিমাণ বই প্রকাশিত হয় এবং বিক্রি হয়, তাতে কথাটি ধোপে টেকে না। সুতরাং নতুন নতুন লেখক তৈরি হচ্ছে। এখন তো নতুন লেখক তৈরির নানা সুযোগ। একজন নতুন লেখকের গল্প বলি।
তাঁর সঙ্গে দেখা এক সেমিনারে। পরিচয় হতেই জানালেন তিনিও লেখক। জানতে চাইলাম, কোথায় লেখেন।
—ফ্রিল্যান্স।
—কোন কোন পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে লেখেন।
—ইন ফ্যাক্ট ইন্টারনেটে।
এখন তো ইন্টারনেট ব্লগের মতো লেখালেখির নানা মাধ্যম হয়েছে। খুশি হয়ে জানতে চাইলাম, সেখানে কোথায়?
—অ্যাজ অ্যা ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, আমি বাংলায় লিখি না, ইংলিশে।
—তা কোন সাইটে বা ফোরামে বা ব্লগে লিখছেন?
মেয়েটি উত্তর দেয়—ফেসবুকে।
তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ-টাইপ আয়োজকেরা এসব লেখকদের দিকে এবার একটু তাকাতে পারেন। তবে তার আগে মার্ক টোয়েনের সেই পুরোনো গল্পটা আবার বলা যেতে পারে।
একদিন একজন এসে মার্ক টোয়েনকে এক লেখকের নতুন বই বের হওয়ার খবর দিয়ে জানতে চাইল, বইটা পড়েছেন?
মার্ক টোয়েন বললেন, হ্যাঁ, দেখেছি।
সেই একজন এবার আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, বইটা কেমন?
মার্ক টোয়েন বললেন, সত্যি বলতে কি, বইটা বন্ধ করলে আর খোলা যায় না।
৩.
বই পড়ার গল্প অনেক হলো। এবার বই পাওয়ার গল্প। বই পড়তে এসে ফেরত না দেওয়া পুরোনো তরিকা। সেই মার্ক টোয়েনের আমল থেকেই। তবে বই মেরে বইয়ের শেলফ ভরা যায় না। বই কিনতে হয়। আর বই কেনার সবচেয়ে ভালো জায়গা বইমেলা। আরও কম বয়সে আমার যখন বুদ্ধি বেশি ছিল, তখন বই পাওয়ার একটা উপায় বের করেছিলাম। কপিরাইটের এই যুগেও সেই আইডিয়াটি এখন ফ্রি বলা যেতে পারে।
আমার বাসায় একটা নোটিশ বোর্ড ছিল। সেই নোটিশ বোর্ডে প্রতিদিন জনগুরুত্বপূর্ণ নানা ধরনের নোটিশ টাঙাতাম। যেমন, একদিন হয়তো নোটিশ বোর্ডে ঝুলল, ‘আজকের রান্না ভালো হয়নি, ভাত ছিল ভর্তা’, আরেক দিন হয়তো বিরিয়ানি খাওয়ার অনুরোধের নোটিশ। এক ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে নোটিশ বোর্ডের সর্বোত্তম ব্যবহার করেছিলাম। সামনেই ছিল জন্মদিন। তাই বইমেলা ঘুরে ঘুরে পছন্দের বইগুলোর একটি তালিকা করে ঝুলিয়ে দিলাম নোটিশ বোর্ডে। নিচে লিখলাম, ‘এই বইগুলো আমার নেই। আমার জন্মদিনে এগুলো দিলেই বেশি খুশি হব।’ টার্গেট ছিল মামা, খালু, চাচা ধরনের মানুষেরা। এমন নয় যে আগের জন্মদিনে তারা আমাকে কিছু দিয়েছিল। কিন্তু এইবার পড়ল ফাঁপরে। চক্ষুলজ্জা বলে একটা ব্যাপার আছে। সেবার আমি অনেক বই পেয়েছিলাম।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। সুতরাং, সাবধান! যে কেউ বই না দিয়ে ইন্টারনেটের একটা লিংক বা ওয়েবসাইটের ঠিকানা ধরিয়ে দিতে পারে। আজকাল সবকিছুই নেটে পাওয়া যায়।
ভাইব্রাদার ভাষা, এফএম ভাষার পর নতুন এসেছে ব্লগের ভাষা। সেই ভাষায় বললে বলতে হয়, নেটে বই পড়ে মাইনষে!
সূত্র : প্রথম আলো
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন