অনেকদিন পর মাসুদের সাথে আমার দেখা - অফিসপাড়ায়। ডাক্তার মাসুদ আমার স্ড়্গুলের সময়ের খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু অনেকদিন কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম, কাছের একটা হোটেলে গিয়ে বসলাম, আর মনে করতে চেষ্টা করলাম সেসব বিষয় আর ঘটনা যেগুলো একসময় আমরা ভুলে যেতে চেষ্টা করেছি।
তার নিজের কথা জিজ্ঞেস করলাম - সে বিয়ে করেছে বছর সাতেক, এক কন্যা নিয়ে ভালোই আছে। মেয়ে স্ড়্গুলে যাওয়া শুরু করেছে। আমিও নিজের কথা বললাম - সোমা আর রায়ানকে নিয়ে আমার চমৎকার দিন কেটে যাচ্ছে। সোমার সাথে আমার প্রেমের বিয়ে, বিয়ের পর যে প্রেম নষ্ট হয়ে যায়নি। আর রায়ানকে আমি ভালোবাসি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি, অফিস থেকে ফেরার পর সে যখন দৌঁড়ে আসে ব্যাগ নেয়ার জন্য - আমার আনন্দের সীমা থাকেনা। তখন বুঝতে পারি - অর্থ-বিত্ত বড় কথা নয়, সামাজিক সম্পর্কগুলোই পরিপূর্ণতা দেয় একজন মানুষের জীবনকে।
স্বাভাবিকভাবেই একপর্যায়ে রাকিবের কথা উঠল। রাকিব, মাসুদ, আর আমি - আমরা তিনজন সবসময় একসাথে চলাফেরা করতাম। রাকিবের সাথেও বহুদিন আমার কোন যোগাযোগ নেই। তবে মাসুদের সাথে নাকি তার প্রায়ই দেখা হয়।
রাকিব বিষয়ে কথায় কথায় অনেক আলাপ হল। কাপের পর কাপ চা শেষ হচ্ছিল আমাদের। ওর সম্পর্কে এমন কিছু ঘটনা শুনলাম, যা সম্পর্কে না আমার জানা ছিল, না কোন ধারণা ছিল। সে যে এতোটা মানসিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে গেছে সে কথা আমি জানতামই না।
তার বিয়ের খবরও আমি পাই নি - বলেছিলাম।
সেও তো প্রায় বছর চারেক হল।
ও, তাহলে তো সে বেশ বয়সেই বিয়ে করেছে।
হ্যাঁ, ও যখন বিয়ে করে - পয়ত্রিশ তো হবেই।
দেরীর কারণ কি? চাকরী-বাকরীর কোন ঝামেলা?
না, আরে, তার তো বিচিত্র এক সমস্যা ছিল।
তারপর মাসুদ পুরো ঘটনা খুলে বলল।
ও মেয়ে দেখতে গিয়ে মেয়ের মায়ের দিকে খেয়াল করে বোঝার চেষ্টা করত, মেয়ে আসলে কি রকম। মেয়েরা নাকি দেখাদেখির সময় এতো সেজে থাকে যে তাদের সত্যিকার চেহারা বা স্বভাব বোঝা সম্্ভব হয় না। তো এতে করে সবকিছু আরো জটিল আকারই ধারণ করেছিল। এক মেয়ের মায়ের অরুচিকরভাবে পান চিবানো দেখে সেই মেয়েকে সে বাতিল করেছিল। আরেক মহিলার স্থূল শরীর দেখে সে নাকি ভদ্রমহিলার মধ্যে ঐ মেয়ের ভবিষ্যতকেই দেখতে পাচ্ছিল - ফলে যথারীতি ওটাও বাদ। এভাবে মেয়ের পর মেয়ে বাতিল হতে থাকল, ওদিকে বাড়তে থাকল তার বয়স।
আমি একদিন বললাম - মেয়ে বুড়ী হবে, তুই বুড়া হবি না! তুইও তো বুড়া হবি। নিজের দিকটা চিন্তা করিস না কেন?
এরপর তার খঁুতখঁুতে ভাব হয়তো কিছুটা কমেছিল। পরে ঢাকার এক মেয়ের সাথেই তার বিয়ে হয়। মেয়েটা সুন্দরই ছিল, একটা ব্যাংকে চাকরী করত। মেয়েটারও বয়স একটু বেশীই ছিল, কিন্তু চেহারার মধ্যে নিষ্পাপ একটা ভাব ছিল।
কিন্তু বিয়ের পর বাঁধল আরেক সমস্যা। আমি তার ডাক্তার বলেই কিনা জানিনা, সে আমাকে অনেক গোপন কথা বলত। আরে, তার এই সমস্যা তো দেখা গেল আরো ভয়াবহ। আমি শেষপর্যন্ত তাকে একজন সায়কায়াট্রিস্টের কাছেও পাঠিয়েছিলাম।
এবার কি সমস্যা? আমাকে বলা যায়? - অনভিপ্রেত হবে জেনেও জিজ্ঞেস করি আমি।
সমস্যা মানে কি - যতবার সে মেয়েটার কাছে যেত, মনে মনে ভাবার চেষ্টা করত - এই মেয়েটা ছোটবেলা দেখতে কেমন ছিল। মেয়েটার ছোটবেলার অ্যালবামের ছবিগুলো সে খঁুটিয়ে খঁুটিয়ে দেখত। সে একরকম অবসেস্ড হয়ে গিয়েছিল। সে বলত, সম্পর্ককে পূর্ণতার দিকে নিতে গেলে শুরু করতে হবে একেবারে ছেলেবেলার সব বিষয়গুলো সম্বন্ধে জানার মাধ্যমে। সম্পর্ক সঠিক পথে পূর্ণতা পাবার আগেই শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গেলে তা আত্মার সম্পর্ককে চিরদিনের মত নষ্ট করে দিবে - এটাই ছিল তার ধারণা।
তা ছেলেবেলা থেকে শুরু করতে গেলে তো অনেক সময় লেগে যাবে, এমনিতেই দেরীর বিয়ে - আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম।
তো সাইকায়াট্রিস্ট তাকে লম্বা থেরাপী দিতে থাকল। এদিকে ঘরের অশান্তি তো আর মেটে না। শেষপর্যন্ত এক পীরের কাছে নেয়া হল তাকে। সেই লোক একসময় স্ড়্গুলশিক্ষক ছিল, পরে কোন কারণে মাথা খারাপ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে তিনি পীর হন, এখন বহু মানুষ তার কাছে উপদেশ নিতে আসে।
তো সেই পীরের কাছে গিয়ে তার উপকার হয়েছিল?
তার ধর্ম-কর্ম একটু বেড়েছিল, কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে গেছে।
তাহলে?
শেষে আমি নিজেও একদিন বসলাম তার সাথে। তাকে ফুলের পরাগায়নের উদাহরণ দিলাম। সেই যে আমরা স্ড়্গুলে পড়েছিলাম - উদি্ভদবিজ্ঞান। ফুল নিজেকে রঙিন করে সাজায়, যেন পতংগ এসে ভীড় করে তার চারদিকে। পতংগকে আকর্ষণ করার এ ব্যাপারটা কেন? কারণ হল - পতংগের সাথে পরাগরেণু চলে যায় ফুলের গর্ভে, সেখানে জন্ম নেয় ফল। এই ফলই হল গাছের ভবিষ্যত প্রজন্ম। প্রকৃতি ফুলকে সাজায় আসলে পোকাগুলিকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে গাছের বংশধারাকে বাঁচিয়ে রাখতে। মানুষের জন্যও একই সত্য। প্রকৃতি যুবক-যুবতীকে সুন্দর করে সাজায় যেন তারা একে অন্যের দিকে ছুটে যায়, নতুন মানুষ জন্ম নেয়। এসবও প্রকৃতিরই খেলা, যেন মানুষ বংশবিস্তার করতে পারে। আসলে এরমধ্যে মহৎ প্রেম খঁুজতে যাওয়া একেবারেই অবৈজ্ঞানিক ধরণের চিন্তা, প্রেমের ধারণাকে সে অর্থে একরকম কুসংস্ড়্গারও বলা যায়।
কিন্তু তোর এই তত্ত্বে মনে হচ্ছে ঈশ্বর একেবারেই অনুপস্থিত - অল্প হেসে বলি আমি - আমার তো ধারণা ছিল, ঈশ্বর ভালোবাসা সৃষ্টি করে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন জীবজগতের মধ্যে।
এসব তো বায়বীয় কথা, কিছুটা ভিত্তিহীনও। তাছাড়া ঈশ্বরের আইডিয়া এখানে একেবারে যে অনুপস্থিত, তাও নয় - সে একটু থামে।
ঐ যে প্রকৃতির কথা বললাম, সেটা তো ঈশ্বরই, তাই না? উদি্ভদ আর প্রানীর যেমন বৈজ্ঞানিক নাম আছে, ঈশ্বরেরও বৈজ্ঞানিক নাম আছে - সে বৈজ্ঞানিক নামটা হল প্রকৃতি। বিজ্ঞানীরা যখন কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে না, তখন তার কারণ হিসেবে প্রকৃতির কথা বলে - এটাই সাম্প্রতিক ফ্যাশান।
তারপর সে আবার আগের প্রসংগ শুরু করল - আমি রাকিবকে বলেছিলাম, তুই তো দেখি প্রেমকে একেবারে পূজা করা শুরু করেছিস। মনে হয় সিনেমায় দেখেছিস যে দুইজনের প্রেম হল, আর অমনি প্রেমিক-প্রেমিকা দৌড়-ঝাঁপ শুরু করল। নাটক-সিনেমা দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারণ নেই, প্রেম সেরকম অমোঘ কিছু না।
তা এগুলি শুনে তার লাভ হয়েছিল?
হয়তো, আমি নিশ্চিত না। তবে পরের বার যখন তার সাথে দেখা হল - তাকে কিছুটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। তার ফ্যামিলির লোকজনের কাছেও শুনেছিলাম, সে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনেই ফিরে গেছে। এমনকি পরে তাদের একটা ছেলেও হয়েছিল।
ছেলে হয়েছিল? তাহলে তো হ্যাপি এন্ডিং বলা যায়?
হয়তো। কিন্তু এবার অন্য একটা ব্যাপার ঘটেছিল, একেবারে ভিন্ন ধরণের একটা সমস্যা ।
আবার সমস্যা? বলে কি? এ লোক তো দেখি সমস্যা থেকে বেরোতেই পারছে না।
হঁ্যা, ঐ যে, যা মাথায় ঢোকে - তা আর বের করতে পারে না। তার মাথায় যে ঢুকেছিল, সবকিছু প্রকৃতির খেলা - সে সেটাই ধরে বসে ছিল। সে ভাবতে শুরু করেছিল - আবেগ বলে জগতে কিছু নেই, আবেগ মানেই প্রকৃতির খেলা। এমনকি শিশুর প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, সেটাও নাকি প্রকৃতির চালাকি। শিশুরা দুর্বল অসহায়, তাদের যাতে আমরা যত্ন করে বড় করে তুলি - সেজন্যই নাকি তাদেরকে মায়াময় করে বানানো হয়। শিশুর প্রতি ভালোবাসা তাই স্বর্গীয় কিছু নয়।
মোটকথা সবাই নিজের জন্যই বাঁচে, নিজের জন্যই সম্পর্কের জাল বুনে। ভালোবাসা বলে পৃথিবীতে কিছু নেই - আছে শুধু কর্তব্য, না হয় উদাসীনতা। সে মনে করত - সবাই একা, আর পার্থিব সম্পর্কগুলো হচ্ছে সাময়িক বিভ্রান্তি। হঁ্যা, বিভ্রান্তিই মনে করতে শুরু করেছিল সে এগুলোকে। সে ধর্ম থেকে উদাহরণ দিয়ে বলত - কেয়ামতের দিন কোন বিভ্রান্তি থাকবেনা, এজন্যই কেউ কাউকে চিনতে পারবে না - মা ছেলেকে চিনবে না, স্ত্রীও স্বামীকে চিনবে না, ইত্যাদি।
তাহলে শেষ কথা কি দাঁড়াল, পৃথিবীতে কেউই আপন নয়?
অনেকটা তাই। বন্ধু বা স্বজন এরা আপন নয়। আপনজন যদি কেউ থাকে সে আছে অন্য কোথাও।
অন্য কোথাও মানে? ঈশ্বরের কথা বোঝাচ্ছে নাকি?
সেটা হতে পারে, আমি নিশ্চিত নই। তাছাড়া এরপর থেকে তার সাথে ইদানীং আমার তেমন একটা যোগাযোগও হয় নি। তবে ঈশ্বর একটা সম্্ভাবনা বই কি !
সে যোগ করে - সত্যি কথা বলতে কি, আমার ধারণা, ঐ পীর না কিসের কাছে সে গিয়েছিল সে লোকই রাকিবের মাথায় এইসব হাবিজাবি ঢুকিয়ে তার সর্বনাশ করেছে। শূন্য থেকে তো আর এগুলো তার মাথায় আসেনি। ঐ লোকই তার মস্তিষ্ড়্গটা ধুয়ে দিয়েছিল কোন এক ফাঁকে - তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে।
গল্প শেষে মামুন ঠান্ডা চায়ের কাপ একপাশে সরিয়ে রাখল।
আমি হাসলাম - ছেলেটা চিরদিনই তাহলে পাগলাটে থেকে গেল।
মামুন হেসে কাঁধ ঝাঁকাল।
সে বিকেলে সেই লম্বা আড্ডা শেষে আমরা রেস্টুরেন্টটা থেকে বেরিয়ে এলাম একসময়, তারপর দুজন দুদিকে চলে গেলাম।
কিন্তু হঠাৎ করেই কেন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি পেয়ে বসল আমাকে - সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে রাস্তায় এলোমেলো হাটতে থাকলাম, বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হল না। সম্পর্কগুলো কি আসলেই বিভ্রান্তি! সোমা আর রায়ানকে আমি কি ভুলে যাব একসময়? মৃত্যু কি ওদের থেকে আমাকে আলাদা করে ফেলবে চিরতরে?
কিছু কিছু মানসিক অসুখও সম্্ভবত ভাইরাসজনিত জ্বরের মতই ছোঁয়াচে, সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে মানুষ থেকে মানুষে গল্প-গুজব আর আড্ডার ভেতর দিয়ে। আর কিছু কিছু লোক সম্্ভবত মানসিক অসুখের বীজ বহন করে, যদিও নিজেরা আক্রান্ত হয়না। এসবই আমার ধারণা, কিন্তু সেদিন রাত গভীর হবার আগেই ব্ল্যাকহোলের মত অতল, সর্বগ্রাসী, অন্ধকার, কড়া এক বিষন্নতা দ্রুত গ্রাস করে নিল আমাকে।
সোনার বাংলাদেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন