ছোট্ট মফস্বল শহরটা ধূলো ওড়া শীত দুপুরের রোদে নির্জন দাঁড়িয়ে আছে। দূরে বড় গাছটার ছায়ার ওপাশে লাল ইটের একটা পুরনো ভবন ছাড়া আর সবগুলো বাড়িই বৈচিত্র্যহীন। রাস্তাগুলো নিশ্চল ফটোগ্রাফের মত বোবা। দো’তলা একটা বাড়ির ছাদে কতগুলো কাপড় রোদে উড়ে উড়ে শুকাচ্ছে। একপাশ দিয়ে টুং টাং শব্দ করতে করতে একটা আইসক্রীমের ভ্যান চলে গেল।
আমি রাস্তার ওপাশের দোকানগুলোর দিকে একবার তাকালাম। মেরামতের অভাবে কিছু অংশ ধ্বসে যাওয়া ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে আসতেই চোখে পড়ল একটা সেলুন - ‘মজনু হেয়ার ড্রেসার’। আমার মনে পড়ল, এরকম একটা নামের কথাই আমাকে বলা হয়েছিল। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে রাস্তাটা পার হয়ে এলাম। দুপুরের আলস্যটা সেলুনের ভেতরেও বেশ জায়গা করে নিয়েছে। কয়েকজন নাপিত চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। আমি ঢুকতেই একজন নড়েচড়ে উঠল - চুল কাটাবেন? শেভ? এখানে ডাক্তার সাহেবের বাড়িটা কোথায়, বলতে পারেন? লোকটা আবার আরাম করে হেলান দিয়ে বসল - ডাইনের গলি ধরে সোজা চলে যান। তিন নাম্বার বাড়ি। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। রোদের মধ্যে এসে দাঁড়াতেই এক ঝাপটা ধূলোমেশানো বাতাস গায়ে পরশ বুলিয়ে দিল। আমি ডানের গলি খুঁজতে লাগলাম। বাড়িটা তিনতলা এবং পুরনো ধাঁচের। গাড়িবারান্দার উপর পুরনো টবে কতগুলো ছোট ছোট গাছ। বাউন্ডারীটা একেবারে নিচু, ইটগুলো শ্যাওলা ধরা। লালরঙা মরচেধরা গেটটার পরেই একটা ছোট্ট আঙিনা দেখা যাচ্ছে, বড়ই গাছের ছায়া আঙিনার ওপর কতগুলো ঘর কেটে রেখেছে। দো’তলা আর তিনতলায় একটা করে ছোট্ট ব্যালকনিও আছে। সবই বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে, কিন্তু বাড়ির নেমপ্লেটটা কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলনা। আমি তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তিনতলার চারটা জানলা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, সবগুলোর পর্দা ফেলা। হলুদ, ময়লা এবং বিবর্ণ কাপড় সেগুলোর। গ্রীলগুলোতেও মরচে ধরেছে। দীর্ঘদিনের অযত্নের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মলিদের বিল্ডিংটা। আমরা যখন পাঁচলাইশ থাকতাম, মলি প্রায়ই বিকেলবেলা আমাদের বাসায় আসত। হাতে সাদা চুরি পরত মেয়েটা। বহুবছর আগের কথা সেসব। মলি তখন ক্লাস নাইন কি টেনে পড়ে। তার মনটা ছিল খুব খোলামেলা। একটা চশমা পড়ত স্টিল ফ্রেমের, অদ্ভুত লাগত দেখতে। আমরা তিন ভাই ওর সাথে গল্প করতাম আর মাঝে মাঝে ক্যারম খেলতাম। কিন্তু সন্ধ্যার পর ওকে বাসায় পৌঁছে দেবার জন্য ও সবসময় আমাকেই নিয়ে যেত আর কথা বলার সময় মিটি মিটি হাসত। সন্ধ্যার রাস্তায় অনেকক্ষণ পাশাপাশি হাটার পর ওদের বারান্দার আলোটা দেখামাত্র ও খুব খুশী হয়ে উঠত। মলিদের চিটাগাঙের বাসাটা ছিল দো’তলা আর সাদা। ওরা বাড়িটার উপরের তলায় থাকত, সন্ধ্যার পর একটা ঝাঁড়বাতি জ্বালিয়ে রাখত বারান্দায়। ওর সবচেয়ে ছোটবোনটা বারান্দায় এসে দড়ি লাফাত, সে দেখতে ছিল হুবহু মলির মত। মলিরা তিন বোন ছিল। মিতালী আর রিমি তখন প্রাইমারীতে পড়ত। বাসায় কেউ গেলেই লুডু খেলার জন্য আটকে রাখতে চাইত ওরা। ঐসময়টা আমি কখনো কখনো ওদেরকে কলেজের কথা বলে তাক লাগিয়ে দিতে চাইতাম। অনেকসময় বানিয়ে বানিয়েও গল্প করতাম। মলি তখন দূরে বসে অল্প অল্প হাসত। অনেকদিন আগে কলেজ জীবনে আমরা সবাই নিজেদের বন্ধনহীন ভাবতেই ভালোবাসতাম। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময় খুব বলাবলি করতাম ‘সবধরণের পিছুটান থেকে মুক্ত হতে না পারলে জগতের মলিনতার ঊর্ধ্বে ওঠা যাবেনা’ জাতীয় উচ্চমার্গের কথাবার্তা, কিন্তু বৃষ্টির দিনগুলোতে জানলার পাশে একা বসে থেকে ভাবতে ভালোবাসতাম হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা। মুখে অস্বীকার করলেও টিনের ওপর রাতের বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে প্রায়ই মলির কথা ভাবতাম আমি। ওরা চিটাগাঙ থেকে চলে যাবার পর কোন কোন দিন সন্ধ্যার সময় ওদের সেই সাদা বাসাটার বারান্দার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলত মনটাকে। অবশ্য এসবই বহুদিন আগের কথা। কি একটা ভেতর থেকে খুব বাধা দিল বলে সেদিন সে বিকেলে বাড়িটা একবার দেখে নিয়েই চলে এলাম। পরদিন বিকেলে ঘড়ি ধরে ঠিক চারটার সময় নড়বড়ে একটা পুরনো রিক্সায় চড়ে আমি মলিদের বাসার দিকে রওনা হলাম। গলির ভেতর দেয়ালগুলোর ছায়া লম্বাটে দেখাচ্ছিল। লোকও ছিল খুব কম। আমি তিন নাম্বার বাড়ির লোহার গেটটার সামনে রিক্সা থামিয়ে নেমে পড়লাম। ওরা চিটাগাঙ থেকে চলে যাবার পর থেকে সবসময়ই কিন্তু আমি রিমিদের সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছি। ঈদে, জন্মদিনে নিয়মিত ভিউকার্ড পাঠাতাম, প্রথমদিকে অনেকগুলো চিঠিও লিখেছিলাম। তারপর একদিন হঠাৎ দেখি, লেখার কোন বিষয় খুঁজে পাচ্ছিনা। তারপর থেকে আমি ওদেরকে ছাপানো কার্ডই পাঠাতাম। সিড়িঘরটা বেশ অন্ধকার, বাইরের রোদে সাতার কেটে আসা একজোড়া চোখের সাপেক্ষে অন্ততঃ। আপেক্ষিক অন্ধকারটায় অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করতে করতেই একসময় দেখি সিড়ি ডিংগিয়ে পৌঁছে গেছি তিনতলায়। চিটাগাঙে ওরা যে বাড়িটায় থাকত, সেটা এর চেয়ে অনেক সুন্দর ছিল। বাড়িটায় এক ঘূর্ণিঝড়ের রাত্রে আমি আর রবিন মেঝেতে শুধু একটা চাদর বিছিয়ে ছিলাম। মলিদের ঐ বাসাটায় এখন নতুন লোক এসেছে, কিন্তু আমি যখন মাঝে মাঝে অন্ধকারে একা হাটি - কেন যেন ঐ বাড়িটার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। কলিং বেল নেই, কড়া নাড়লাম। অনেকক্ষণ কোন সাড়া নেই। আবার কড়া নাড়লাম। সামান্য ধুপধাপ পায়ের শব্দ হয়ে দরোজা খুলে গেল। যে মেয়েটার মুখ দেখা গেল, আঠার-ঊনিশের মত বয়স, তাকে আমি প্রথমে চিনতে পারলাম না। এটা মিতালীদের বাসা না? সে উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ করেই বলে উঠল - রাকিব ভাইয়া! সে আমাকে চিনতে পেরেছিল, কিন্তু সম্ভবতঃ বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। কয়েক মুহূর্তের বিহ্বলতার পর অবশ্য দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল সে - কতোদিন পর! ভেতরে আসেন। দরজাটা খুলে দিল সে। সবাই ঘুমে? - আমিও ততক্ষণে মিতালীকে চিনতে পেরেছি। না, রিমি কলেজে। আপনি বসেন। আমি আম্মাকে বলে আসি। সে ভেতরে চলে গেল। আমি ড্রইংরুমটা দেখতে লাগলাম। সোফাটা, শোকেসটা সেই আগের মতই আছে। রাশান ধরণের পুতুলটাও সেই আগের দিনগুলির মত শোকেজের পুরো একটা পাশ দখল করে বসে আছে। মলি কিন্তু প্রথমেই আমাকে চিনতে পারল। সে যে কখন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। একসময় সে ভেতরে এসে বসল। হেসে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছি। ওর পরনে ছিল একটা সবুজ পাঞ্জাবী। আমার মনে পড়ল, আগে সবুজ রঙটা একদম পছন্দ করতো না ও। ঐসময় সাদা রঙটাই পছন্দ ছিল ওর। বাসার বাইরে যেতে সবসময় সাদা রঙের চুড়ি পরত সে। হঠাৎ এদিকে? - সে জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম। অডিটের কাজে শহরে শহরে ঘুরতে হয় শুনে ও খুব খুশী হয়ে উঠল, বলল এ ধরণের জীবনই ওর পছন্দ। সে নিজে অবশ্য একটা গোছানো জীবনই বেছে নিয়েছিল। অনেক লেখাপড়া করে স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা না করে খুব কম বয়সেই বিয়ে করে ফেলেছিল। ওর পরিবেশ হয়তো মলিকে বাইরের জগতে এসে মুক্ত বাতাসে দাঁড়ানোর সাহস দেয়নি, কিন্তু এখন সে যেরকম আছে সেটাও মন্দ না। শাওনও বেশ ভালো আছে। শাওন এখন হামাগুড়ি দিতে পারে। - সে বলল। শাওন তার মেয়ের নাম। অনেক আগে আমাদের তিন ভাইয়ের কাছে মলিকে যখন ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা সুন্দর স্বপ্ন বলেই শুধু মনে হতো, তখন আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে - মলি জীবনে যেখানেই যাক, আশেপাশের সবার মধ্যে একটা প্রধান আকর্ষণ হয়েই থাকবে। ঐসময়টা মলি চুলে বেনী করত খুব সুন্দর করে, হাসিতেও কেমন করে যেন একটা মোহময়তা ছড়িয়ে রাখত সবসময়। ওর চাহনীতে একটা রহস্য ছিল, যেটাকে অনতিক্রম্য বলেই মনে হত আমাদের কাছে। এখন কৌতূহল নিয়ে আবার যখন ওর চোখের দিকে তাকালাম আর জিজ্ঞেস করলাম সে ঘুমাচ্ছিল কিনা, সে বলল যে দুপুরে একটু না ঘুমালে তার প্রচন্ড মাথাব্যথা হয়। ওর মুটিয়ে যাবার এটাও একটা কারণ। আমি একসময় লক্ষ্য করলাম, কথা বলার সময় ওর পিঠে বেনী দু’টো দুলে উঠলনা। অনেকদিন আগে বাসের বিরক্তিকর একটা ভ্রমণের সময় ‘রেড’ নামে সমারসেট মমের একটা গল্প পড়েছিলাম। সেই যে স্যালির উদাসীনতা আর সময়ের আগ্রাসন নীলসনের ভালোবাসাকে একসময় একটা বোধহীন বিপর্যয় করে তুলেছিল। শেষে সে বলেছিল (পুরোটা আমার মনে নেই), ‘ভালোবাসার সত্যিকার বিয়োগান্ত পরিণতি মৃত্যু বা বিচ্ছেদ নয়। ••• ••• যে নারীকে আপনি একদিন সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন, যাকে চোখের আড়াল করা আপনার কাছে অসহনীয় বলে মনে হত, তাকে আর কোনদিন না দেখলেও আপনার কিছু এসে যাবে না - এই উপলধ্বিটা কতটা ভয়ংকর, চিন্তা করা যায়! আসলে ভালোবাসার সত্যিকার বিয়োগান্ত পরিণতি হল উদাসীনতা।’ নীলসনের কথা ভেবেই কিনা জানি না, আমি খুব সাবধানে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। ঘর থেকে হঠাৎ বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই আমাকে বলে মলি উঠে ভেতরে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ পরই মিতা চা বানিয়ে নিয়ে এল, সাথে চানাচুর আর মিষ্টি। সে বলল, ওদের এলাকাটার এই মিষ্টিটা খুব ভালো। আমরা যারা সেই পুরাতন শহরটায় একসাথে বড় হয়েছি বহুদিন আগে, তাদের অনেকের সাথেই এখন আর আমার যোগাযোগ নেই -এমনকি মামুনের সাথেও না। ছোটকাল থেকেই খুব ভালো বন্ধু ছিল ও আমার। কিন্তু যেদিন এয়ারপোর্টে ওকে তুলে দিতে গেলাম, সেদিন কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল - কিছু্ই আর আগের মত থাকবে না। হয়তো অনেক বছর পর রাস্তায় ওকে দেখে চিনতে পারব না। সে রাতে আমার মনে হয়েছিল, জীবনটা একটা চলমান দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু না। জ্বালাতন - মলি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল। আপনি এখন বুঝতে পারছেন না, আপনি কত ভালো আছেন। সে সামনে এসে বসল। আমি হাসলাম। সেদিন ওদের দু’জনের সামনে বসে থেমে থেমে চলতে থাকা প্রসংগগুলোর মাঝে আমি লক্ষ্য করলাম - প্রায়ই আমি কথা বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। একবার মিতালী আরেকবার মলির মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কাছে এদের সাথে দেখা করতে আসা সহ পুরো ব্যাপারটাকেই কেন যেন খুব অর্থহীন মনে হতে লাগল। যা কাল থাকবে না, তার জন্য আমার অতি উচ্ছ্বাস আর বড় বড় কল্পনার কথা মনে হতেই নিজের ওপর সীমাহীন একটা বিরক্তিতে মনটা ছেয়ে গেল। অদ্ভুত একটা অবসন্নতা নিয়ে আমি বসে রইলাম ওদের দু’জনের সামনে। সেদিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন গলিটা থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি, পেছন ফিরে হঠাৎ ব্যালকনিটায় মিতালীকে চোখে পড়ল - বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছিল। বিকেলের শেষ রোদের ঝাপটায় আকাশটা ঝকমক করছিল, বারান্দায় ওরা দাঁড়িয়ে ছিল - দু’জন একসাথে, দু’জন একা। বিবর্ণ ব্যালকনিটায় ওদেরকে দেখে আমার অনেক আগের কথা মনে পড়ছিল, যখন ঈদের পরের দিনগুলি আমরা ছোটরা মন খারাপ করে কাটাতাম ‘ঈদটা চলে গেল’ ভেবে। আমরা অসহায়ের মত আনন্দের সময়গুলির চলে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছি, আবার একসময় এসে দাঁড়িয়েছি একটা পুরাতন শহরের রোদ কমে আসা গলিতে। একবার উপরে তাকিয়ে দেখলাম, আকাশের একটা বড় অংশ ইতিমধ্যে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কোথা থেকে যেন ঠান্ডা একটা বাতাস আসছিল। দূরে কোথাও মাইকে সিনেমার গান বাজাচ্ছে। বিলীয়মান রৌদ্রের বিকেলে চটুল হিন্দী গানগুলোকে একসময় খুব বিষন্ন শোনাতে লাগল। আমি পুরনো গলিটা থেকে বেরিয়ে এলাম, একসময় আবার নেমে এলাম সেই ধূলো ওড়া শহুরে রাস্তায়। ফিরছিলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। সন্ধ্যার আগেই টিকেটটা করে ফেলার ইচ্ছে ছিল। রাস্তায় তখন কলেজ ফেরতা ছেলেমেয়েদের ভীড়। কলেজটা কাছে কোথাও, বিকেলে সম্ভবতঃ ব্যবহারিক ক্লাস হয়। আমি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে হাটছি আর ভাবছি বিচিত্র সব কথা। যা থাকবে না, তা কেন আসে? যা আমাদের করতে ভালো লাগে, তা বেশিরভাগ সময়ই কেন ভুল কাজ? ঠিক কতদিন অপেক্ষার পর মানুষ তার অনুভূতির অপ্রয়োজনীয় এবং যন্ত্রণাদায়ক অংশগুলি থেকে মুক্তি পাবে? একরোখা নির্বোধ কতগুলি প্রশ্ন আমি বহন করি আর ফুটপাতের উপর হাটতে থাকি, কিন্তু হঠাৎই আবার থমকে দাঁড়াই। আমি একটা মেয়েকে দেখতে পাই - সে কলেজ থেকে ফিরছে। আমি বুঝতে পারিনা এটা আমার কল্পনাপ্রবণতাজনিত কোন বাস্তববিবর্জিত প্রকল্প কিনা, কিন্তু মেয়েটাকে আমার অনেকদিনের চেনা বলেই মনে হতে থাকে। এমনকি একসময় আমাকে একটা অযৌক্তিক প্রত্যয়ও পেয়ে বসে যে, এটা সত্যিই মলির ছোটবোন রিমি। আমি ভালো করে তাকাই, কিন্তু বিস্ময়টা কাটতে চায় না। বরং একসময় আমার মনে হতে থাকে, আমি আমার সুদূর কৈশোরের কোন এক মলিকে দেখছি, যে কখনো কখনো স্ট্রীটলাইটের আলোতে আমার পাশাপাশি হাটত। মেয়েটা আমার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। যখন দেখলাম মেয়েটার চুলগুলো বেনী হয়ে সামনে এসে মাথার দু’পাশে দুলছে, তখন আমি যেন ওর বড় বড় চোখ দু’টোয় সামান্য রহস্যময়তাও দেখতে পেলাম। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, অনেকক্ষণ। দেখছিলাম, অনেকগুলো মানুষের ভেতর মেয়েটা ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না - মলিকে নয়, আমার জীবনের কিছু টুকরো স্মৃতিকে আমি এতোদিন মাথার ভেতর সযত্নে রক্ষা করে এসেছি। ফলে এতোদিন পরও একটা পুরাতন শহরের দালানে আর রাস্তায় আমি সেই মুখ আবিষ্কারের একটা নির্বোধ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছি। আমার পুরো বিশ্লেষণটাই সম্ভবতঃ ভুল ছিল, কারণ সেদিন সেই সন্ধ্যার অন্য এক আলোয় দাঁড়িয়ে আমি লক্ষ্য করলাম - আমার অনেকদিনের পরিচিত সেই মুখটা অজস্র নতুন মুখের ভীড়ে একসময় খুব সহজেই হারিয়ে গেল।সোনার বাংলাদেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন