তর্জনীটা ছবির গালে একবার বুলিয়ে নিয়ে নিজের ঠোঁটে স্পর্শ করে চুক চুক জাতীয় একটা আদুরে শব্দ করলেন মহিলা, আর মুখে বললেন, পু-ও-র বয় ...। সেদিনের পত্রিকার প্রথম পাতা জুড়ে ছাপা ছিলো হিথ লেজারের মুখ। হলিউডের সদ্য প্রয়াত নায়ক। জাতে অস্ট্রেলিয়ান ছিলেন। মৃত্যুর পরপরই এখানকার মিডিয়ায় তাই কদিন ধরেই ফোকাসে ছিলেন এই মানুষটা, টিভি কি পত্রিকা, সবখানেই।
ভদ্রমহিলার বয়েস অনেক। কখনোই ঠিকঠাক আন্দাজ করতে পারে না আহসান, তবু মনে হয় ষাট হবে অথবা পয়ষট্টি। কালো ফ্রেমের চশমা চোখে, লম্বা ঝুলের গাউন ধরণের পোষাক পরনে। চুলগুলো ভেজা ভেজা, চেপে আঁচড়ানো। সব মিলিয়ে বেশ সম্ভ্রান্ত একটা চেহারা, সেই সাথে খুব আপন আপন। অনেক আগের, সেই ছেলেবেলাকার ইশকুলের এক প্রবীণা শিক্ষিকার কথা মনে পড়ে গেলো ওঁকে দেখে, যে শিক্ষিকাকে আবার আহসানের মনে হত নিজের নানুর মত।
কাউন্টারের এ পাশে দাঁড়ানো সে, পত্রিকা তুলে নিয়ে স্ক্যান করতে যাবে, তখুনি ছবিতে আঙুল বুলিয়ে মন্তব্য করলেন মহিলা। আহসান একটু থমকে গেল যেন। নিজের এপার্টমেন্টে খুঁজে পাওয়া গেছিলো হিথ-কে। ঊনত্রিশ হাজার ডলার ভাড়ার সেই বাসায় পড়ে ছিলো তার পোষাকহীন মৃত দেহ। প্রচুর ড্রাগ নিতেন হিথ লেজার, মৃত্যুর কারণ হিসেবে সেটাই আপাতত ধারণা করেছে ডাক্তাররা। দীর্ঘকাল ডিপ্রেশানে ভুগছিলেন নানা কারণে। তাই প্রচুর ওষুধ নিতেন, মৃত্যুর কারণের তালিকায় রয়েছে এটাও।
মহিলার কথার উত্তরে আহসান একটু মাথা ঝোঁকালো কেবল। মুখে বলল, 'হুম, খুব স্যাড।'
আহসানের পাশের ক্যাশ রেজিষ্টারে দাঁড়িয়ে ছিলো ওর ভারতীয় সহকর্মী - রামিনিত সিং। ওদের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ কথা শুনছিলো। হঠাৎ কি হলো, মহিলার কথা শুনে রীতিমতন উড়ে এলো সে। ' পুওর? পুওর বলছো তুমি ওকে? কি পরিমাণ ড্রাগস নিতো তুমি জানো? আর কত বেশি ওষুধ? জানো? এরকম সহানুভুতি কি পেতে পারে ও?'
মহিলা কেমন চমকে উঠে তাকালেন ওর দিকে। কি যেন ভাবলেন খানিকক্ষণ, তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করতে করতে বললেন, ' হুম, ড্রাগস নিতো, ওষুধ খেতো ... সে জন্যেই মরেছে। কিন্তু, ইন আদার সেন্স, হয়তো এই কারণেই সে পুওর ছিল, হয়তো এ কারণেই আরো বেশি সহানুভুতির দরকার ছিলো তার।' একটা ছোট্ট নিঃশ্বাসের বিরতি নিয়ে আবার বলে উঠলেন, 'কোন না কোন অর্থে আমরা সবাই হয়তো এরকম, আমরা সবাই-ই হয়তো পুওর!'
পত্রিকার পয়সা দিয়ে মহিলা চলে গেলেন। রামিনিত এমনিতে শান্ত-শিষ্ট ছেলে। আজ এরকম ক্ষেপে উঠলো দেখে আহসান খুব অবাক হল। মৃদু স্বরে শুধু বলল, 'এতটা রুড না হলেও হতো।' ওকে খানিকটা বিষণ্ণ দেখালো। বললো, 'হয়ত। কিন্তু জানো, এরকম যদি আমাদের দেশে হতো, তাহলে ওরা কত কিছু বলতো, নেশারু, ইরেসপন্সিবল। আর ওদের এখানে মরেছে দেখে কত সহানুভুতি! আবার বলে পুওর বয়!' অনেকক্ষণ আপন মনে অনেক কথা বলেই চললো ও। এ দেশীয় সাদাদের গোষ্ঠী উদ্ধার করলো অনেকক্ষণ। এই রাগের মাঝেও বিষন্ন শোনালো রামিনিতের গলা, মাঝে মাঝেই। আহসানের একটু খারাপই লাগছিলো। এই রাগের পেছনের কাহিনি সম্ভবত সে জানে।
শহরের মাঝামাঝি ব্যস্ত একটা এলাকায় বেশ বড়সড় পেট্রোল স্টেশন ওদের। কাস্টমার সার্ভিসের কাজ, সারাদিনে শ'চারেক নানা কিসিমের লোকের সাথে হাসিমুখে ডিল করতে হয়। প্রায় প্রতিবারই উত্তরে হাসিমুখ দেখা যায়। তবু, মাঝে মাঝে দুয়েকজন আসে যারা ভ্রু কুঁচকে রাখে সারাক্ষণ। চোখের দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় - বাপু হে, তোমার ঐ ঘিনঘিনে বাদামী গায়ের রং আমার পছন্দ হচ্ছে না।
কয়েকদিন আগেই এমনি একজনের সাথে গোল বেঁধে গিয়েছিলো রামিনিতের। গাড়িতে তেল ভরে ভেতরে এসে বলে সাথে টাকা নেই, পার্স ভুলে গেছে। রামিনিত ঠান্ডা মাথায় ফোন এগিয়ে দেয়, পরিচিত কাউকে ফোন করে ক্রেডিট কার্ডের নম্বর নিতে বলে। ঐ লোকটা কেন যেন ক্ষেপে যায়। অযথাই বাজে কথা বলে বসে ওকে। তর্কের এক পর্যায়ে ঐ ব্যাটা বলেই বসে - ব্লাডি ইন্ডিয়ান! হসান বুঝতে পারে, আজকের ঘটনার শানে নুযুল আসলে গাঁথা আছে সেই দিনটাতেই। সহকর্মীর জন্যে খারাপ লাগে ওর খানিকটা, প্রায় একই ঘটনার সামনে যে সে-ও পড়ে নি কখনো, এমনটা নয়। মাথার ভেতর অযথাই ঘুরতে থাকে সাদা-কালো-বাদামী শব্দগুলো।
আট ঘন্টার শিফট শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই। ম্যানেজারের রুম থেকে হঠাৎই ডাক আসে ওর জন্যে। নাক বোঁচা ম্যানেজার ওদের, সম্ভবত হংকং-এ বাড়ি। এখনও অবিবাহিতা। শুধু শুধুই ডাকা। সামনের সপ্তাহে একটা পাবলিক হলিডে আছে, সে দিন কাজ করতে পারবে নাকি অন্য কোন পরিকল্পনা আছে - এই নিয়ে মিনিট পাঁচেকের খেজুরে আলাপ।
ম্যানেজারের রুম থেকে বাইরে বেরুতেই কাউন্টারে দাঁড়ানো রামিনিত হাত ইশারা করে ওকে, 'নাম্বার টেন'। এই ইশারার মানে জানে আহসান। দশ নাম্বার পাম্পে কেউ একজন তেল ভরছে, যার গাড়ির রেজিস্ট্রেশান এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না ঠিকঠাক। খানিকটা দ্রুত পায়ে দরজার কাছে চলে যায় আহসান, ইদানীং ড্রাইভ অফ অনেক বেড়ে গেছে আগের চেয়ে, তেল ভরেই সোজা পালিয়ে যায় লোকে, পয়সা দেয় না। গাড়ির নাম্বার জানা না থাকলে বিপদে পড়তে হবে, পুলিশে ফোন করে জানাবার কোন উপায় থাকবে না আর।
লোকটাকে দেখা যাচ্ছে এখন। ছিপছিপে লম্বা একজন লোক, মাথায় হ্যাট। সম্ভবত আফ্রিকান।
একটু দ্রুত পা বাড়ায় ও। কালোদের ওপর বিশ্বাস নেই। এ দেশে হাজার রকম অপরাধ করে বেড়ায় ওরা, তেল চুরি তার মধ্যে সবচে নিরীহ গোছের। রেজিস্ট্রেশান প্লেটটা দেখা যাচ্ছে না এখনো। আরো কাছে যেতে হবে। লোকটা কি দেখে ফেলেছে নাকি ওকে? তেল নেওয়া থামিয়ে দিলো কেন?
এইবার খানিকটা দৌড়ের মতন হাঁটা দিলো ও। লোকটাও এগুচ্ছে গাড়ির দরজার দিকে। পালাবেই নাকি শেষমেষ? যাহ শালা!
নাহ, পালালো না। ড্রাইভিং সিটের ওপরে রাখা পার্সটা তুলে নিয়ে এ দিকে হাঁটা দিলো লোকটা, পয়সা দিতেই আসছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আহসানও ফিরে এলো স্টোরে। কাউন্টারে যাবার আগে কি ভেবে ফ্রেশ হতে চলে এলো সে রেস্টরুমে। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিলো খানিকক্ষণ। ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলো সে। গাড়ির নাম্বার দেখার আগেই লোকটা পালিয়ে গেলে আজ আবার ম্যানেজারের ঝাড়ি শুনতে হতো তাকে। এত করে বলেছে বাইরে সিকিউরিটি ক্যামগুলো ঠিক করতে তাড়াতাড়ি। পাঁচটার মধ্যে চারটাই কাজ করে না। যেটা করে, সেটা দিয়ে কোন গাড়িরই রেজো প্লেট দেখা যায় না।
ই স, আজ যদি কাল্লুটা সত্যি পালিয়ে যেত! মুখে আরেকবার পানির ঝাপটা মেরে ও চোখ তুলে তাকায়। বেসিনের ওপরেই একটা আয়না ঝোলানো সেখানে। ওদিকে তাকিয়েই মুহুর্তের জন্যে চমকে যায় সে! আয়নায় যাকে দেখছে সে আহসান নয়। ক'দিন আগে রামিনিতকে গাল দেয়া সেই সাদা লোকটাই যেন হা হা করে হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। আহসান শুনতে পেল, আজ সকালের সেই মহিলাটা যেন কানের পাশ থেকে ওকে ফিসফিস করে বলছে, 'ওহ, পু-ও-র বয়!'
সূত্র : বিক্ষণ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন