গল্পটা বলেছিল হাজামবাড়ির মজিদ।
গল্পকে সে বলত কিচ্ছা। আমার কিশোরবেলার কথা। গ্রামে নানির কাছে একা একা থাকি। সন্ধ্যাবেলা মজিদ মাঝে মাঝে আমাকে কিচ্ছা শোনাতে আসত। রাক্ষস খোক্ষস, জিন পরী, দেও দানব, ভুত পেতনি আর রাজরাজার কিচ্ছা।
এই কিচ্ছাটা ছিল ডাকাতের।
এক দুর্ধর্ষ ডাকাত রামদা হাতে বনোপথে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই পথে টাকা-পয়সা সোনাদানা নিয়ে যে যায় রামদায়ের এক কোপে ধর থেকে তার মুন্ডুটা আলগা করে দেয় সে। তারপর তার টাকা-পয়সা সোনাদানা নিয়ে বাড়ি যায়। সংসারে বউ ছেলেমেয়ে আছে। তারা খুবই আরাম আয়েশে জীবন কাটায়।
একদিন সেই বনোপথ ধরে এক সাধু আসছিল। ডাকাত তার সামনে রামদা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধু বললেন, আমাকে তুমি খুন করতে চাও কেন?
তোমার কাছে যা আছে সেসব ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য।
সেটা তো তুমি আমাকে খুন না করেও নিতে পার?
তা পারি, কিন্তু মানুষ খুন করা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ১০০টি খুন করেছি, তোমাকে খুন করলে খুনের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০১।
আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
পারো।
ডাকাতির টাকা-পয়সা সোনাদানা দিয়ে তুমি কী করো?
কী আর করব। সংসার চালাই। বউ-ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ করি।
কিন্তু ডাকাতি আর মানুষ খুন করে তুমি যে পাপ করছ এই পাপের দায়ভার কি তোমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা নেবে?
ডাকাত একটু চিন্তিত হলো। তা তো জানি না।
কোনো দিন কি জানার চেষ্টা করেছ?
না।
এখন গিয়ে জেনে আসো।
আর তুমি?
আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় বসে থাকব।
ডাকাত হাসল। তুমি কি আমাকে এতই বোকা মনে করো? আমি তোমাকে এখানে বসিয়ে রেখে ওসব কথা জানতে যাই আর সেই ফাঁকে তুমি পালাও। ওটি হবে না বাপধন।
তাহলে এক কাজ করো। আমাকে এই গাছের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে যাও, যাতে আমি পালাতে না পারি।
হ্যাঁ, এটা হতে পারে।
তাহলে তা-ই করো।
সাধুকে একটি গাছের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে বাড়ি গেল ডাকাত। গিয়ে স্ত্রীকে প্রথমে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এই যে আমি ডাকাতি করে, মানুষ খুন করে টাকা-পয়সা রোজগার করে তোমার ভরণপোষণ করি, তাতে যে আমার পাপ হয়, এই পাপের অর্ধেক দায়ভার কি তুমি নেবে?
স্ত্রী অবাক। কেন তোমার পাপের দায়ভার আমি নেব?
যেহেতু তুমি আমার স্ত্রী। আমার অর্ধাঙ্গিনী।
স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী যা-ই বলো আমার ভরণপোষণ এবং সংসার পরিচালনার দায় তোমার। তুমি কীভাবে কোন পদ্ধতিতে রোজগার করে সংসার চালাচ্ছ সেটা আমার দেখার ব্যাপার না। আমি শুধু দেখব তুমি আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারছ কি না। অন্য কিছুই আমার দেখার ব্যাপার না। রোজগার করতে গিয়ে তোমার যদি কোনো পাপ হয় সেই পাপের দায়ভার তোমার। পৃথিবীতে কারও পাপের দায়ভার অন্য কেউ নিতে পারে না।
ডাকাত চিন্তিত হলো।
গেল ছেলের কাছে। ছেলেও একই কথা বলল। পিতা হিসেবে আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার। সেই দায়িত্বের জন্য তুমি খুন করছ না ডাকাতি করছ তা আমি ভাবতে যাব কেন? তোমার পাপের ভার আমি নিতে যাব কেন? তোমার পাপ তোমার।
ডাকাত গেল মেয়ের কাছে। মেয়েরও একই কথা।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ডাকাত ফিরে এল বনে। এসে দেখে যে গাছের সঙ্গে সাধুকে বেঁধে রেখে গিয়েছিল সাধু সেই গাছের তলায়ই বসে আছেন কিন্তু তাঁর শরীরে কোনো বাঁধন নেই। মোটা মোটা দড়ি পড়ে আছে সাধুর পায়ের কাছে।
ডাকাত হতভম্ব। এ কী করে সম্ভব? এত শক্ত বাঁধন তুমি কী করে খুলেছ?
সাধু বললেন, আমি খুলিনি। আপনা আপনিই খুলে গেছে।
ডাকাত বুঝে গেল সাধু ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই সাধু বললেন, এবার বলো যে কথা জানতে তুমি গিয়েছিলে সে কথা জেনেছ কি না?
ডাকাত মাথা নিচু করে বলল, জেনেছি।
তোমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে কী বলল? তারা কি নেবে তোমার পাপের দায়ভার?
না কেউ নেবে না। তিনজনই পরিষ্ককার বলে দিয়েছে আমার পাপের যাবতীয় দায়ভার আমার। আমার পাপ অন্য কেউ ভাগ করে নেবে না।
তাহলে বোঝো। যাদের ভরণপোষণের জন্য ডাকাতি করছ তুমি, মানুষ খুন করার মতো ভয়াবহ পাপ করছ তারা কেউ তোমার পাপের দায়ভার নেবে না। তোমার পাপ শুধুই তোমার। তাহলে কি লাভ এই পাপ করে?
ডাকাত হাতের রামদা ছুড়ে ফেলে দিল। তাই তো। তারপর সাধুর পা জড়িয়ে ধরল। সাধুবাবা, আমি এখন কী করব? এই ১০০টি খুনের পাপ আমি কীভাবে মোচন করব? ডাকাতি করে যে পাপ করেছি সেই পাপ কী করে মোচন করব?
সাধু বললেন, ওই যে মরা গাছটা দেখছ, এক্ষুনি গিয়ে ওই গাছের তলায় বসো। বসে ভগবানকে ডাকতে থাকো। ভগবান, আমার পাপ মোচন করো। আমার পাপ মোচন করো। যেদিন দেখবে মরা গাছে সবুজ পাতা গজিয়েছে সেদিন বুঝবে ভগবান তোমার পাপ মোচন করেছেন। তোমার জন্য স্বর্গের দরজা খুলে যাবে।
সাধুর কথায় ওই মুহুর্তেই বদলে গেল ডাকাত। জগৎ সংসার ভুলে, স্ত্রী-সন্তান ভুলে মরা গাছের তলায় গিয়ে বসল। ভগবানকে ডাকতে শুরু করল।
দিন যায়, রাত যায়। ডাকাত শুধু ভগবানকেই ডাকে।
মাস যায়, বছর যায়। ডাকাত শুধু ভগবানকেই ডাকে।
কিন্তু তার পাপ মোচন হয় না। মরা গাছে গজায় না সবুজ পাতা।
একদিন ডাকাত দেখে বনের ধারে একজন কাউকে কবর দিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। সন্ধ্যার দিকে তারা কাজ সেরে চলে যাওয়ার পর বিশাল চাঁদ উঠল আকাশে। ফুটফুটে জ্যোৎস্মায় ভরে গেল চারদিক। ডাকাত উদাস চোখে জ্যোৎস্মা দেখছে আর মনে মনে ভগবানকে ডাকছে। এ সময় দেখা গেল একটি লোক কোদাল হাতে সেই কবরটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কোদাল চালিয়ে মাটি খুঁড়ল সে, লাশ তুলে আনল। লাশের শরীর থেকে কাফনের কাপড় সরানোর পর এতটা দুর থেকেও ডাকাত দেখতে পেল, লাশটি খুব সুন্দরী একটি মেয়ের। লোকটি তারপর সেই লাশের ওপর নিজের বদমতলব হাসিল করার প্রস্তুতি নিল। এই দেখে ভগবানকে ডাকতে ভুলে গেল ডাকাত। তক্ষুনি ছুটে গেল সেখানে। কোদালের কোপে হত্যা করল লোকটিকে। মেয়েটির লাশ সসম্মানে, সযত্নে কবরে শুইয়ে দিল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে যতটা যত্ন সম্ভব ততটা যত্নে কবরের ওপর মাটিচাপা দিল। এসব কাজ শেষ করে সে যখন তার আগের জায়গায়, মরা গাছটির তলায় ফিরে এসেছে, এসে দ্যাখে চাঁদের আলোয় চকচক করছে মরা গাছের ডালপালা। সবুজ পাতায় ভরে গেছে মরাগাছ। অর্থাৎ ডাকাতের পাপ মোচন হয়েছে। ঈশ্বর তার পাপ ক্ষমা করেছেন।
মানুষ আসলে এভাবে বদলায়। বদলের মন্ত্রটা তাকে দিয়ে দিতে হয়। তার প্রাণে গেঁথে দিতে হয়, তুমি এইভাবে বদলাও। আমাদের মায়েরা, স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা, সন্তানেরা চিরকাল খারাপ পথ থেকে প্রিয় মানুষটিকে ফেরানোর মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে খুবই সহজ একটা অস্ত্র। ছেলে খারাপ কাজ করছে, খারাপ পথে চলছে, মা ছেলেকে শপথ করিয়েছেন, আমার মাথায় হাত দিয়ে বল, খারাপ কাজ তুই আর করবি না। খারাপ পথে তুই আর চলবি না।
মায়ের মাথায় হাত দিয়ে শপথ করা ছেলে খারাপ কাজটি আর করতে পারেনি। খারাপ পথে আর চলতে পারেনি। মায়ের সঙ্গে করা প্রতিজ্ঞা সে ভাঙবে না। ভাঙলে যদি মায়ের কোনো অনিষ্ট হয়? মায়ের মরা মুখ যদি দেখতে হয়?
প্রিয়তমা স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা নেশাভাঙ করা প্রিয় মানুষটিকেও ওই একই কায়দায় ফিরিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করো আর নেশা করবে না। করলে আমার মরা মুখ দেখবে।
নেশার সোনালি জগৎ থেকে ফিরে এসেছে মানুষটি।
কিছুতেই সিগারেট ছাড়তে পারছে না সংসারের কর্তা। তার আদরের সন্তানটি বলল, তুমি সিগারেট না ছাড়লে আমি তোমার সামনে যাব না, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। যদি আমার চেয়ে সিগারেট তোমার বেশি প্রিয় হয় তাহলে তুমি সিগারেট নিয়েই থাক।
ভদ্রলোক সিগারেট ছেড়ে দিলেন।
আমি এক ভদ্রলোককে চিনি। এমন একটা জায়গায় চাকরি করেন, প্রতিদিন ১০-২০ হাজার টাকা ঘুষ খাওয়া তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই না। ভদ্রলোক একটি পয়সাও ছুঁয়ে দেখেন না। বেতনের টাকায় অতিকষ্টে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চালান। তাঁর সহকর্মীরা সবাই বাড়িগাড়ি করে ফেলেছে।
ভদ্রলোক কেন ঘুষ খান না?
চাকরিতে ঢোকার আগে বাবা তাঁকে শপথ করিয়েছিলেন, কোনো দিন একটি পয়সাও ঘুষ খাবে না। সেই শপথ মেনে চলছেন তিনি। সত্যিকার শপথের এমন এক শক্তি থাকে, পৃথিবীর কোনো প্রলোভনই সেই শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠে না।
মানুষ বদলায় নিজের শপথে। অন্যকে বদলে দেয় তার ভেতরে শপথের শক্তি তৈরি করে। বিবেককে জাগ্রত করিয়ে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিষ্টি পছন্দ করতেন। মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। একদিন এক সাহাবি আসছেন তাঁর কাছে। হুজুর, আমার খুবই মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস। আমি মিষ্টি খাওয়া ছাড়তে চাই। আপনি আমাকে পথ দেখান।
মহানবী (সা.) বললেন, আপনি সাত দিন পর আসবেন। তখন আমি আপনাকে বলব কীভাবে মিষ্টি ছাড়বেন।
সাহাবি সাত দিন পর এলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে পথ দেখালেন। আপনি যদি প্রতিদিন চারটি মিষ্টি খান, তাহলে আজ খাবেন তিনটি। কাল খাবেন দুটো। তারপর দিন একটি। এভাবে চেষ্টা করলে অল্প দিনের মধ্যেই আপনি মিষ্টি ছাড়তে পারবেন।
সাহাবি খুব খুশি। জি হুজুর। আমি এভাবেই চেষ্টা করব। কিন্তু হুজুর, এই পরামর্শ দেওয়ার জন্য আপনি সাত দিন সময় নিলেন কেন? কারণটা জানার খুব কৌতুহল হচ্ছে।
মহানবী (সা.) বললেন, আমার নিজেরও মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল। এই সাত দিনে সেই অভ্যাস আমি পরিত্যাগ করতে পেরেছি। নিজের অভ্যাস না বদলে সেই বিষয়ে আপনাকে আমি কী করে পরামর্শ দেব?
এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না। এই ঘটনার অর্থই হচ্ছে, বদলে যাও বদলে দাও। আগে নিজে বদলাও, তারপর অন্যকে বদলে দাও।
গল্পকে সে বলত কিচ্ছা। আমার কিশোরবেলার কথা। গ্রামে নানির কাছে একা একা থাকি। সন্ধ্যাবেলা মজিদ মাঝে মাঝে আমাকে কিচ্ছা শোনাতে আসত। রাক্ষস খোক্ষস, জিন পরী, দেও দানব, ভুত পেতনি আর রাজরাজার কিচ্ছা।
এই কিচ্ছাটা ছিল ডাকাতের।
এক দুর্ধর্ষ ডাকাত রামদা হাতে বনোপথে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই পথে টাকা-পয়সা সোনাদানা নিয়ে যে যায় রামদায়ের এক কোপে ধর থেকে তার মুন্ডুটা আলগা করে দেয় সে। তারপর তার টাকা-পয়সা সোনাদানা নিয়ে বাড়ি যায়। সংসারে বউ ছেলেমেয়ে আছে। তারা খুবই আরাম আয়েশে জীবন কাটায়।
একদিন সেই বনোপথ ধরে এক সাধু আসছিল। ডাকাত তার সামনে রামদা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধু বললেন, আমাকে তুমি খুন করতে চাও কেন?
তোমার কাছে যা আছে সেসব ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য।
সেটা তো তুমি আমাকে খুন না করেও নিতে পার?
তা পারি, কিন্তু মানুষ খুন করা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ১০০টি খুন করেছি, তোমাকে খুন করলে খুনের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০১।
আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
পারো।
ডাকাতির টাকা-পয়সা সোনাদানা দিয়ে তুমি কী করো?
কী আর করব। সংসার চালাই। বউ-ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ করি।
কিন্তু ডাকাতি আর মানুষ খুন করে তুমি যে পাপ করছ এই পাপের দায়ভার কি তোমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা নেবে?
ডাকাত একটু চিন্তিত হলো। তা তো জানি না।
কোনো দিন কি জানার চেষ্টা করেছ?
না।
এখন গিয়ে জেনে আসো।
আর তুমি?
আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় বসে থাকব।
ডাকাত হাসল। তুমি কি আমাকে এতই বোকা মনে করো? আমি তোমাকে এখানে বসিয়ে রেখে ওসব কথা জানতে যাই আর সেই ফাঁকে তুমি পালাও। ওটি হবে না বাপধন।
তাহলে এক কাজ করো। আমাকে এই গাছের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে যাও, যাতে আমি পালাতে না পারি।
হ্যাঁ, এটা হতে পারে।
তাহলে তা-ই করো।
সাধুকে একটি গাছের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে বাড়ি গেল ডাকাত। গিয়ে স্ত্রীকে প্রথমে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এই যে আমি ডাকাতি করে, মানুষ খুন করে টাকা-পয়সা রোজগার করে তোমার ভরণপোষণ করি, তাতে যে আমার পাপ হয়, এই পাপের অর্ধেক দায়ভার কি তুমি নেবে?
স্ত্রী অবাক। কেন তোমার পাপের দায়ভার আমি নেব?
যেহেতু তুমি আমার স্ত্রী। আমার অর্ধাঙ্গিনী।
স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী যা-ই বলো আমার ভরণপোষণ এবং সংসার পরিচালনার দায় তোমার। তুমি কীভাবে কোন পদ্ধতিতে রোজগার করে সংসার চালাচ্ছ সেটা আমার দেখার ব্যাপার না। আমি শুধু দেখব তুমি আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারছ কি না। অন্য কিছুই আমার দেখার ব্যাপার না। রোজগার করতে গিয়ে তোমার যদি কোনো পাপ হয় সেই পাপের দায়ভার তোমার। পৃথিবীতে কারও পাপের দায়ভার অন্য কেউ নিতে পারে না।
ডাকাত চিন্তিত হলো।
গেল ছেলের কাছে। ছেলেও একই কথা বলল। পিতা হিসেবে আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার। সেই দায়িত্বের জন্য তুমি খুন করছ না ডাকাতি করছ তা আমি ভাবতে যাব কেন? তোমার পাপের ভার আমি নিতে যাব কেন? তোমার পাপ তোমার।
ডাকাত গেল মেয়ের কাছে। মেয়েরও একই কথা।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ডাকাত ফিরে এল বনে। এসে দেখে যে গাছের সঙ্গে সাধুকে বেঁধে রেখে গিয়েছিল সাধু সেই গাছের তলায়ই বসে আছেন কিন্তু তাঁর শরীরে কোনো বাঁধন নেই। মোটা মোটা দড়ি পড়ে আছে সাধুর পায়ের কাছে।
ডাকাত হতভম্ব। এ কী করে সম্ভব? এত শক্ত বাঁধন তুমি কী করে খুলেছ?
সাধু বললেন, আমি খুলিনি। আপনা আপনিই খুলে গেছে।
ডাকাত বুঝে গেল সাধু ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই সাধু বললেন, এবার বলো যে কথা জানতে তুমি গিয়েছিলে সে কথা জেনেছ কি না?
ডাকাত মাথা নিচু করে বলল, জেনেছি।
তোমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে কী বলল? তারা কি নেবে তোমার পাপের দায়ভার?
না কেউ নেবে না। তিনজনই পরিষ্ককার বলে দিয়েছে আমার পাপের যাবতীয় দায়ভার আমার। আমার পাপ অন্য কেউ ভাগ করে নেবে না।
তাহলে বোঝো। যাদের ভরণপোষণের জন্য ডাকাতি করছ তুমি, মানুষ খুন করার মতো ভয়াবহ পাপ করছ তারা কেউ তোমার পাপের দায়ভার নেবে না। তোমার পাপ শুধুই তোমার। তাহলে কি লাভ এই পাপ করে?
ডাকাত হাতের রামদা ছুড়ে ফেলে দিল। তাই তো। তারপর সাধুর পা জড়িয়ে ধরল। সাধুবাবা, আমি এখন কী করব? এই ১০০টি খুনের পাপ আমি কীভাবে মোচন করব? ডাকাতি করে যে পাপ করেছি সেই পাপ কী করে মোচন করব?
সাধু বললেন, ওই যে মরা গাছটা দেখছ, এক্ষুনি গিয়ে ওই গাছের তলায় বসো। বসে ভগবানকে ডাকতে থাকো। ভগবান, আমার পাপ মোচন করো। আমার পাপ মোচন করো। যেদিন দেখবে মরা গাছে সবুজ পাতা গজিয়েছে সেদিন বুঝবে ভগবান তোমার পাপ মোচন করেছেন। তোমার জন্য স্বর্গের দরজা খুলে যাবে।
সাধুর কথায় ওই মুহুর্তেই বদলে গেল ডাকাত। জগৎ সংসার ভুলে, স্ত্রী-সন্তান ভুলে মরা গাছের তলায় গিয়ে বসল। ভগবানকে ডাকতে শুরু করল।
দিন যায়, রাত যায়। ডাকাত শুধু ভগবানকেই ডাকে।
মাস যায়, বছর যায়। ডাকাত শুধু ভগবানকেই ডাকে।
কিন্তু তার পাপ মোচন হয় না। মরা গাছে গজায় না সবুজ পাতা।
একদিন ডাকাত দেখে বনের ধারে একজন কাউকে কবর দিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। সন্ধ্যার দিকে তারা কাজ সেরে চলে যাওয়ার পর বিশাল চাঁদ উঠল আকাশে। ফুটফুটে জ্যোৎস্মায় ভরে গেল চারদিক। ডাকাত উদাস চোখে জ্যোৎস্মা দেখছে আর মনে মনে ভগবানকে ডাকছে। এ সময় দেখা গেল একটি লোক কোদাল হাতে সেই কবরটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কোদাল চালিয়ে মাটি খুঁড়ল সে, লাশ তুলে আনল। লাশের শরীর থেকে কাফনের কাপড় সরানোর পর এতটা দুর থেকেও ডাকাত দেখতে পেল, লাশটি খুব সুন্দরী একটি মেয়ের। লোকটি তারপর সেই লাশের ওপর নিজের বদমতলব হাসিল করার প্রস্তুতি নিল। এই দেখে ভগবানকে ডাকতে ভুলে গেল ডাকাত। তক্ষুনি ছুটে গেল সেখানে। কোদালের কোপে হত্যা করল লোকটিকে। মেয়েটির লাশ সসম্মানে, সযত্নে কবরে শুইয়ে দিল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে যতটা যত্ন সম্ভব ততটা যত্নে কবরের ওপর মাটিচাপা দিল। এসব কাজ শেষ করে সে যখন তার আগের জায়গায়, মরা গাছটির তলায় ফিরে এসেছে, এসে দ্যাখে চাঁদের আলোয় চকচক করছে মরা গাছের ডালপালা। সবুজ পাতায় ভরে গেছে মরাগাছ। অর্থাৎ ডাকাতের পাপ মোচন হয়েছে। ঈশ্বর তার পাপ ক্ষমা করেছেন।
মানুষ আসলে এভাবে বদলায়। বদলের মন্ত্রটা তাকে দিয়ে দিতে হয়। তার প্রাণে গেঁথে দিতে হয়, তুমি এইভাবে বদলাও। আমাদের মায়েরা, স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা, সন্তানেরা চিরকাল খারাপ পথ থেকে প্রিয় মানুষটিকে ফেরানোর মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে খুবই সহজ একটা অস্ত্র। ছেলে খারাপ কাজ করছে, খারাপ পথে চলছে, মা ছেলেকে শপথ করিয়েছেন, আমার মাথায় হাত দিয়ে বল, খারাপ কাজ তুই আর করবি না। খারাপ পথে তুই আর চলবি না।
মায়ের মাথায় হাত দিয়ে শপথ করা ছেলে খারাপ কাজটি আর করতে পারেনি। খারাপ পথে আর চলতে পারেনি। মায়ের সঙ্গে করা প্রতিজ্ঞা সে ভাঙবে না। ভাঙলে যদি মায়ের কোনো অনিষ্ট হয়? মায়ের মরা মুখ যদি দেখতে হয়?
প্রিয়তমা স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা নেশাভাঙ করা প্রিয় মানুষটিকেও ওই একই কায়দায় ফিরিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করো আর নেশা করবে না। করলে আমার মরা মুখ দেখবে।
নেশার সোনালি জগৎ থেকে ফিরে এসেছে মানুষটি।
কিছুতেই সিগারেট ছাড়তে পারছে না সংসারের কর্তা। তার আদরের সন্তানটি বলল, তুমি সিগারেট না ছাড়লে আমি তোমার সামনে যাব না, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। যদি আমার চেয়ে সিগারেট তোমার বেশি প্রিয় হয় তাহলে তুমি সিগারেট নিয়েই থাক।
ভদ্রলোক সিগারেট ছেড়ে দিলেন।
আমি এক ভদ্রলোককে চিনি। এমন একটা জায়গায় চাকরি করেন, প্রতিদিন ১০-২০ হাজার টাকা ঘুষ খাওয়া তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই না। ভদ্রলোক একটি পয়সাও ছুঁয়ে দেখেন না। বেতনের টাকায় অতিকষ্টে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চালান। তাঁর সহকর্মীরা সবাই বাড়িগাড়ি করে ফেলেছে।
ভদ্রলোক কেন ঘুষ খান না?
চাকরিতে ঢোকার আগে বাবা তাঁকে শপথ করিয়েছিলেন, কোনো দিন একটি পয়সাও ঘুষ খাবে না। সেই শপথ মেনে চলছেন তিনি। সত্যিকার শপথের এমন এক শক্তি থাকে, পৃথিবীর কোনো প্রলোভনই সেই শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠে না।
মানুষ বদলায় নিজের শপথে। অন্যকে বদলে দেয় তার ভেতরে শপথের শক্তি তৈরি করে। বিবেককে জাগ্রত করিয়ে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিষ্টি পছন্দ করতেন। মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। একদিন এক সাহাবি আসছেন তাঁর কাছে। হুজুর, আমার খুবই মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস। আমি মিষ্টি খাওয়া ছাড়তে চাই। আপনি আমাকে পথ দেখান।
মহানবী (সা.) বললেন, আপনি সাত দিন পর আসবেন। তখন আমি আপনাকে বলব কীভাবে মিষ্টি ছাড়বেন।
সাহাবি সাত দিন পর এলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে পথ দেখালেন। আপনি যদি প্রতিদিন চারটি মিষ্টি খান, তাহলে আজ খাবেন তিনটি। কাল খাবেন দুটো। তারপর দিন একটি। এভাবে চেষ্টা করলে অল্প দিনের মধ্যেই আপনি মিষ্টি ছাড়তে পারবেন।
সাহাবি খুব খুশি। জি হুজুর। আমি এভাবেই চেষ্টা করব। কিন্তু হুজুর, এই পরামর্শ দেওয়ার জন্য আপনি সাত দিন সময় নিলেন কেন? কারণটা জানার খুব কৌতুহল হচ্ছে।
মহানবী (সা.) বললেন, আমার নিজেরও মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল। এই সাত দিনে সেই অভ্যাস আমি পরিত্যাগ করতে পেরেছি। নিজের অভ্যাস না বদলে সেই বিষয়ে আপনাকে আমি কী করে পরামর্শ দেব?
এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না। এই ঘটনার অর্থই হচ্ছে, বদলে যাও বদলে দাও। আগে নিজে বদলাও, তারপর অন্যকে বদলে দাও।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন