প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা সবই আল্লাহর জন্য। তিনি আমাদেরকে সূষ্টি করেছেন। আমাদেরকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও বুঝবার শক্তি এবং ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতাও দিয়েছেন। আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন ও নেতৃত্ব দানের জন্য তিনি তাঁর সর্বোত্তম বান্দাদেরকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা মানুষকে মানবতা শিক্ষা দিয়েছেন, সৎলোকের মতো জীবনযাপন করা শিখিয়েছেন এবং মানব জীবনের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেছেন। যে সমস্ত নিয়ম-নীতি অনুযায়ী জীবন যাপন করলে মানুষ দুনিয়ায় সুখ-শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারে তাও তারা বলে এবং করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সবার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
সমবেত ভদ্রমন্ডলী ও মহিলাবৃন্দ!
যে আল্লাহ্ এই দুনিয়াকে সৃষ্টি করে পৃথিবী পৃষ্ঠকে বিছানার মতো করে তৈরী করেছেন এবং তার উপর মানুষের বসবাস করার সুব্যবস্থা করেছেন, তিনি অন্ধের মতো আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে কোন কাজ করেন না। কোন কিছু না দেখেশুনে অন্ধকারে হাতড়িয়ে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেবার মতো বাদশাহ তিনি নন। তাঁর নিজস্ব আইন-কানুন, বলিষ্ঠ নিয়ম-নীতি, সুদৃঢ় ব্যবস্থা ও সুষ্ঠু কর্মপদ্ধতি রয়েছে। তদনুযায়ী তিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের উপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব করছেন। পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, পানি, বাতাস, বৃক্ষ, পশু-পাখি ইত্যাদির মতো আমরা গোটা মানব জাতিও তাঁর প্রাকৃতিক আইন ও নিয়মের অধীনে সুসংবদ্ধ। আমাদের জন্ম ও মৃতু্য, আমাদের শৈশব, আমাদের যৌবন ও বার্ধক্য, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের পাকস্থলী ও রক্ত চলাচল, আমাদের সুস্থতা ও অসুস্থা ইত্যাদি সব কিছুর উপরই তাঁর চিরন্তন প্রাকৃতিক আইন ও নিয়মের কর্তৃত্ব একটানাভাবে রীতিমত চলছে। এছাড়া তাঁর আর একটা আইনও রয়েছে। সেটা তাঁর প্রাকৃতিক আইনের মতই আমাদের ইতিহাসে উঠা-নামা, আমাদের উত্থান-পতন, আমাদের উন্নতি-অবনতি এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত -তথা দেশ ও জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের উপর কর্তৃত্ব করছে। আল্লাহর প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নাকের বদলে চোখের সাহয্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করা এবং পেটের বদলে হৃদয়ে খাদ্য হজম করা যদি মানুষের পক্ষে সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে যে পথে চললে আল্লাহর আইন অনুযায়ী কোন জাতির অধপতন হওয়া উচিত, সেই পথে তার উন্নতি হওয়া সম্বব নয়। আগুন যেমন একজনের জন্য গরম এবং আরেক জনের জন্য ঠান্ডা নয়, তেমনি আল্লাহর আইন অনুযায়ী যে সমস্ত কাজ খারাপ তা একজনকে অবনত এবং অন্য জনকে উন্নত করতে পারে না। মানুষের ভাল-মন্দের জন্য আল্লাহ্ যে নিয়ম-নীতি নির্ধারিত করেছেন, তা কারোর চেষ্টায় পরিবর্তিত ও বাতিল হতে পারে না। তার ভেতর কারো সঙ্গে শত্রুতা এবং কারো সঙ্গে স্বজনপ্রীতিও নেই। আল্লাহর এই আইনের সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে এই যে, তিনি গড়া পছন্দ করেন এবং ভাঙ্গা পছন্দ করেন না। সব কিছুর মালিক হিসেবে তিনি তাঁর দুনিয়াকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে চান। একে অতিমাত্রায় সুসজ্জিত করতে চান। তাঁর যাবতীয় উপায় উপাদান এবং শক্তি ও যোগ্যতাকে সুষ্ঠু পন্থায় সদ্ব্যবহার করতে চান। তিনি কখনও তাঁর দুনিয়ার ধ্বংস ও অনিষ্ট সাধন করেন না। বিশৃংখলা, কুকর্ম, অত্যাচার ও অনাচার করে তাঁর দুনিয়াকে শ্রীহীন সৃষ্টিতে পরিণত করাকে তিনি কোনদিন পছন্দ করবেন বলে আশাও করা যেতে পারে না। যে সমস্ত লোক দুনিয়া পরিচালনার ক্ষমতা লাভ করতে চায় তাদের ভেতর থেকে কেবলমাত্র তারাই আল্লাহর দৃষ্টিতে যোগ্যতাসম্পন্ন হয়; যারা এ দুনিয়াকে গড়বার যোগ্যতা অন্যদের চেয়ে বেশী রাখে। এরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদেরকেই তিনি দুনিয়া পরিচালার দায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন।
অতঃপর এসব ক্ষমতাসীন লোকেরা কতটুকু ভাঙ্গে এবং কতটুকু গড়ে -সেদিকে তিনি তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ভাঙ্গার চেয়ে গড়তে থাকে বেশী এবং তাদের চেয়ে বেশী গড়ে কম ভাঙ্গে -এমন কেউ কর্মক্ষেত্রে থাকে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ তাদের সমস্ত দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও দুনিয়া পরিচালনার ক্ষমতা তাদের হাতেই রাখেন। কিন্তু যখন তারা গড়ে কম এবং ভাঙ্গে বেশী, তখন আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমতাচু্যত করে অন্য লোকদেরকে ঐ একই শর্তে ক্ষমতা দিয়ে থাকেন।
এটা একটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আইন। আপনাদের বিচার বুদ্ধিও প্রমাণ করবে যে, আইনটি এমনই হওয়া উচিত। যদি আপনাদের কারোর একটি বাগান থাকে এবং তিনি একজন মালীকে তার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করেন, তাহলে আপনি নিজেই বলুন, তিনি ঐ মালীর নিকট সর্বাগ্রে কি আশা করতে পারেন? তিনি অবশ্যি নিজের বাগানের ক্রমোন্নতি চাইবেন। তার শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শোভা-সৌন্দর্য এবং উৎপাদন বৃদ্ধিই হবে তার কাম্য। যে মালীকে তিনি দেখবেন অত্যন্ত প্ররিশ্রম, যোগ্যতা ও মনোযোগ সহকারে সুনিপুণভাবে বাগানের সেবা যত্ন করছে, বাগানের সাজসজ্জার দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখছে, তার চেষ্টা ও যত্নে ভাল দরকারী গাছগুলো বেশ সতেজ ও সুন্দর হচ্ছে, সে আগাছা, আবর্জনা ও বন-জঙ্গল পরিষ্কার করছে তার সুরুচি ও শিল্প শক্তি দিয়ে উৎকৃষ্ট ও নতুন ফল-মূল এবং ফুলের উৎপাদন বৃদ্ধি করছে- তার উপর তিনি অবশ্যই সন্তুষ্ট হবেন। তিনি তাকে ভালবাসবেন এবং উচ্চ মর্যাদা দেবেন। এমন উপযুক্ত, কর্তব্যপরায়ণ, পরিশ্রমী, অনুগত ও সুযোগ্য মালীকে তাড়িয়ে দেয়া তিনি কোন দিনই পছন্দ করবেন না। কিন্তু এ না হয়ে যদি ঠিক এর উল্টোঁাই হয় অর্থাৎ, যদি তিনি দেখেন যে, মালী অযোগ্য-অপদার্থ, আলসে ও ফাঁকিবাজ, সে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে বাগানের ক্ষতি করছে, গোটা বাগানটা আবর্জনা ও বন-জঙ্গলে ভরে গিয়েছে, গাছের পাতা ও ডালগুলো ভেঙে পড়েছে, কোথাও বিনা প্রয়োজনে পানি বয়ে যাচ্ছে, আবার কোথাও পানির অভাবে মাটি ও গাছপালা সব শুকিয়ে যাচ্ছে, ঘাস, আগাছা, বনজঙ্গল ও আবর্জনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, ফুল ও ফলবান গাছগুলোকে অকাতরে কেটে কেটে ফেলে দেয়া হচ্ছে, ভাল ভাল গাছগুলো মরে গিয়ে আগাছায় বাগান ভরে যাচ্ছে, তাহলে বলুন, বাগানের মালিক এমনতর মালীকে কি করে পছন্দ করতে পারে? কোন সুপারিশ, কাকুতি-মিনতি, সবিনয় নিবেদন ও প্রার্থনা এবং উত্তরাধিকার ও মনগড়া অধিকারের দরুন মালিক তার বাগানের দায়িত্বভার এমন অযোগ্য মালীর উপরই ন্যস্ত রাখবে? বড় জোর এতটুকু হতে পারে যে, সে মালীকে শাসিয়ে দিয়ে আর একবার তাকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেবে। কিন্তু যে মালীর কোন শাসনেই চৈতন্য হয় না এবং ক্রমাগত বাগানের ক্ষতিই করতে থাকে, তাকে কান ধরে বের করে দিয়ে অন্য কোনো ভাল মালী নিযুক্ত করা ছাড়া মালিকের পক্ষে এ সমস্যার আর কি সমাধান হতে পারে?
যদি নিজের সামান্য একটা বাগান পরিচালনার ব্যাপারেও আপনি অনুরূপ পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। তাহলে চিন্তা করে দেখুন যে, আল্লাহ্ তাঁর এতবড় ভূমন্ডলটা এত সব উপায়-উপকরণসহ মানুষের কর্তৃত্বাধীনে রেখে দুনিয়া ও তার সমস্ত বস্তুর উপর তাকে এত ক্ষমতা ও অধিকার দিয়েছেন, এক্ষেত্রে মানুষ তাঁর দুনিয়াকে সুন্দর করে গড়ে তুলছে, না ধ্বংস করছে, এ বিষয়টা তিনি কি করে উপেক্ষা করতে পারেন? আপনি যদি তাঁর দুনিয়াকে সুন্দর করে গড়তে থাকেন তবুও তিনি আপনাকে ক্ষমতা থেকে অযথা সরিয়ে দেবেন- এমনতর হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু যদি আপনি গঠনমূলক কোন কিছু না করেন এবং আল্লাহর এ বিরাট বাগানখানাকে একেবারে উজাড় ধ্বংস করতেই থাকেন তাহলে আপনার দাবীকে নিজের বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী যতই জোরদার মনে করুন না কেন তিনি তাঁর বাগানে আপনার কোন অধিকারই স্বীকার করবেন না। প্রথমে তিনি আপনাকে শাসিয়ে হুঁশিয়ার করে দেবেন এবং সংশোধনের দু'চারটে সুযোগ দেবেন। পরিশেষে আপানাকে পরিচালকের মর্যাদা থেকে পদচু্যত করেই ছাড়বেন।
এ ব্যাপারে একটা বাগানের মালিকের দৃষ্টিকোণ ও মালীর দৃষ্টিকোণ যেমন বিভিন্ন তেমনি আল্লাহর দৃষ্টিকোণ ও মানুষের দৃষ্টিকোণের মধ্যেও বিভিন্নতা রয়েছে। ধরুন, মালীদের এক পরিবার বংশানুক্রমে একজন লোকের বাগানে কাজ করে আসছে। তাদের পূর্ব পুরুষের কাউকে হয়তো তার যোগ্যতা ও জ্ঞান বুদ্ধির দরুন বাগানে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তার সন্তান-সন্ততিও বাগানের কাজ সুন্দরভাবে করেছিল, তাই বাগানের মালিক চিন্তাকরে দেখলো যে, অযথা এদেরেকে সরিয়ে অন্য মালী নিযুক্ত করার কি দরকার? এরা ও যখন ভালভাবেই কাজ করছে, তখন এদের অধিকার অন্যের চেয়ে বেশী। এভাবে মালীদের এই বংশ স্থায়ীভাবে বাগানে কাজ করতে লাগলো। কিন্তু কিছু কাল পরে এই বংশের মালীরা একেবারে অযোগ্য, অপদার্থ, ফাঁকিবাজ, আলসে, কুঁড়ে ও অবাধ্য হয়ে পড়ল। বাগান পরিচালনার কোন যোগ্যতাই তাদের রইল না। এখন তারা গোটা বাগানটার সর্বনাশ করতে শুরু করেছে, তবুও তদের দাবী এই যে তারা তাদের বাপদাদার আমল থেকে পুরুষানুক্রমে এ বাগানে বাস করে আসছে, তাদের পূর্ব পুরুষদের কারুর দ্বারা এ বাগান গড়ে উঠেছিল, কাজেই এতে তাদের জন্মগত অধিকার রয়েছে এবং তাদেরকে সরিয়ে অন্য কাউকে এ বাগানের পরিচালনার জন্য মালী নিযুক্ত করা কোনক্রমেই সংগত হতে পারে না। এটিই ঐ অযোগ্য ও অপদার্থ মালীদের দৃষ্টিকোণ। কিন্তু বাগানের মালিকের দৃষ্টিকোণও কি অনুরূপ হতে পারে? সে কি একথাই বলবে না_ আমার কাছে তো বাগানের সুন্দর ও সুষ্ঠ পরিচালনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আমি তো মালীদের কোন পূর্ব পুরুষের জন্য এ বাগান করিনি। বরং তাদের পূর্ব পুরুষের কাউকে আমার বাগানের কাজের জন্য চাকর রেখেছিলাম। বাগানে তাদের যা কিছু অধিকার আছে তা যোগ্যতা ও কাজের শর্তাধীন। তারা বাগানকে ঠিকমত গড়ে তুললে তাদের সমস্ত অধিকার বিবেচনা করা হবে। নিজের পুরানো মালীদের সংগে আমার এমন কি শক্রতা থাকতে পারে যে, তারা ভালভাবে কাজ করলেও আমি অযথা তাদেরকে তাড়িয়ে অন্য মালীদেরকে নিযুক্ত করবো? কিন্তু যে বাগানের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তোমাদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছিল সেটিকেই যদি তোমরা নষ্ট ও উজাড় করে ফেল, তাহলে তোমাদের কোন অধিকারই আমি স্বীকার করবো না। অন্য যারা এ কাজ ঠিকমত করতে চায় আমি তাদেরকে বাগান পরিচালনার দায়িত্ব ও ক্ষমতা দান করবো এবং তাদের অধীনে তোমাদের চাকুরি করতে হবে। এতেও যদি তোমরা ঠিক না হও এবং অধীনস্ত হিসেবেও যদি তোমরা অকেজো প্রমাণিত হও; বরং শুধু নষ্ট করতেই থাক, তাহলে আমি তোমাদেরকে এ বাগান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে অন্য মালীদেরকে এখানে নিযুক্ত করবো।
দৃষ্টিকোণের এই পার্থক্য যেমন একটা বাগানের মালিক ও মালীর মধ্যে রয়েছে, তেমনি রয়েছে দুনিয়ার মালিক ও দুনিয়াবাসীদের মধ্যেও। দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন জাতি তাদের আপন আপন এলাকাকে স্বদেশ ভূমি বলে দাবী করে। বংশানুক্রমে তারা এবং তাদের পূর্ব-পুরুষগণ সেখানে বসবাস করে আসছে। তাদের দেশের উপর তাদের কর্তৃত্ব করার জন্মগত অধিকার রয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করে। কাজেই তাদের মতে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা একমাত্র তাদেরই প্রাপ্য। বাইরের আর কারুর সেখানে কর্তৃত্ব করার কোন অধিকার নেই। এ হচ্ছে দুনিয়াবাসীদের দৃষ্টিকোণ। কিন্তু দুনিয়ার আসল মালিক আল্লাহর দৃষ্টকোণ এটা নয়। তিনি কখনো এ সব জাতীয় অধিকার স্বীকার করেননি। প্রত্যেক দেশের উপর তার অধিবাসীদের জন্মগত অধিকার রয়েছে এবং সে অধিকার থেকে তাদেরকে কোনক্রমেই বঞ্চিত করা চলবে না- এমন কোন কথা তিনি স্বীকার করেন না। তিনি তো দেখেন, কোন্ দেশে কোন্ জাতি কি কাজ করছে। যদি কোন জাতি তার দেশে গঠনমূলক কাজে লিপ্ত থাকে, তার সমস্ত শক্তিসামর্থ দুনিয়ার সংশোধন ও উন্নতির জন্য নিয়োগ করে থাকে, সব রকমের মন্দ কাজ প্রতিরোধ করে এবং ভাল কাজের ক্ষেত্র প্রশস্ত করতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে দুনিয়ার মালিক বলেন, অবশ্য তোমরা দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার অধিকারী। তোমরা পূর্ব থেকেই এ দেশে বসবাস করে আসছো এবং দেশ পরিচালনারও যোগ্যতা রাখ। কাজেই অন্যান্য জাতির চেয়ে তোমাদের অধিকারই অগ্রগণ্য। কিন্তু যদি ব্যাপারটা উল্টো হয় অর্থাৎ, যদি গড়ার পরিবর্তে শুধু ভাঙ্গার কাজই হতে থাকে, সৎ কাজের বদলে দেশ জুড়ে কেবল অসৎ ও অবৈধ কাজই সংঘটিত হয় এবং আল্লাহ্ দুনিয়ায় যা সৃষ্টি করেছেন তাকে কোন ভাল কাজে না লাগিয়ে বেপরোয়া ভাবে নষ্ট করা হয়- এক কথায় দেশকে গড়ার বদলে ভেঙ্গে ফেলা হয়- তাহলে আল্লাহ্ এহেন জাতিকে প্রথমে কিছুটা হালকা এবং কিছুটা কঠিন আঘাত দেন, যাতে করে তারা সতর্ক হয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করতে পারে। এতেও যে জাতি ঠিক না হয়, তার কাছ থেকে দেশের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অন্তত এর চেয়ে যোগ্যতর জাতিকে দেয়া হয়।
এখানেই শেষ নয়। যদি পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা পরাধীন হওয়ার পরও কোন যোগ্যতা ও গুণবৈশিষ্ট্যের প্রমাণ না দেয় এবং কার্যকলাপের মাধ্যমে এ কথাই প্রমাণ করে যে, বিকৃতি করা ছাড়া তাদের দ্বারা আর কোন কাজই হবে না, তাহলে এহেন জাতিকে আল্লাহ্ নিশ্চিহ্ন করে দেন। তারপর তাদের স্থানে অন্য কোন জাতিকে আনেন। এ ব্যাপারে সব সময়ই মালিকের যে দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত, আল্লাহরও তাই হয়ে থাকে। তিনি তাঁর দুনিয়া পরিচালনার ক্ষেত্রে দাবীদার ও প্রার্থীদের উত্তরাধিকার অথবা জন্মগত অধিকার দেখেন না। তিনি দেখেন কার গড়ার যোগ্যতা বেশী এবং ভাঙ্গার দিকে ঝোঁক প্রবনতা কম রয়েছে। একই সময়ের প্রার্থীদের মধ্যে যারা এ দিক দিয়ে যোগ্যতর বলে প্রমাণিত হয়, তাদেরকেই দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করা হয়। যতদিন এদের ধ্বংসাত্মক কাজের চেয়ে গঠনমূলক কাজ বেশী হতে থাকে অথবা এদের তুলনায় বেশী ভাল করে গঠনমূলক কাজ করে এবং ধ্বংসাত্মক কাজও কম করে- এমন কেউ এগিয়ে না আসে- ততদিন দেশ পরিচালনার ক্ষমতা এদের হাতেই রাখা হয়।
এসব যা কিছু আমি বলছি, ইতিহাসে এর জ্বলন্ত প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ্ চিরকালই এ নীতি অনুযায়ী তাঁর দুনিয়া পরিচালনার ব্যবস্থা করছেন। দূর দেশের কথা না হয় ছেড়েই দিন। নিজেদের এ দেশের ইতিহাসটাই পর্যালোচনা করুন। এ দেশে যে সব জাতি প্রথমে বাস করতো, তাদের গঠনমূলক যোগ্যতা ও কর্ম ক্ষমতা যখন শেষ হয়ে গেল, তখন আল্লাহ্ আর্য জাতিকে এ দেশ পরিচালনার সুযোগ দিলেন। সে সময় অন্যান্য জাতি গুলোর মধ্যে যোগ্যতম ছিল আর্যজাতি। তারা এখানে এসে এক উন্নত তামাদ্দুন ও সভ্যতা গড়ে তুললো। বহু জ্ঞান ও শিল্প আবিস্কার করল। ভূগর্ভের গোপন সম্পদ উদ্ধার করে তাকে ভাল কাজে ব্যবহার করল। ধ্বংসাত্মক কাজের তুলনায় গঠনমূলক কাজই তারা বেশী করেছিল। এসব যোগ্যতা যতদিন পর্যন্ত তাদের মধ্যে ছিল ততদিন ইতিহাসের সমস্ত উত্থান-পতন সত্ত্বেও তারাই ছিল এদেশের পরিচালক। অন্যান্য জাতি ক্ষমতা দখলের জন্য বার বার এগিয়ে এসেছে কিন্তু তাদেরকে হটিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ, আর্যদের মতো যোগ্য জাতি ক্ষমতাসীন থাকা কালে অন্যকোন পরিচালকের প্রয়োজন ছিল না। আর্যরা যখন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে বিপথে চলা শুরু করে, তখন তাদের উপর যেসব বৈদেশিক আক্রমন হয়, সেগুলোকে তাদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে সতর্ককারী দূত স্বরূপ বলা যায়। কিন্তু তারা সতর্ক না হয়ে ধ্বংসাত্মক কাজেই লিপ্ত থাকে। গঠনমূলক কাজের তুলনায় তারা ধ্বংসাত্মক কাজ করতে থাকে অনেক বেশী। তাদের নৈতিক অধঃপতন এমন চরমে পৌঁছে যে, বামমার্গ আন্দোলনে আজো তার চিহ্ন আপনারা সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারেন। মানবতাকে বিভক্ত করে তারা নিজেদেরই সমাজকে বর্ণ ও গোত্রে খণ্ডিত করল। সমাজ জীবনকে একটি সিঁড়ির মতো করে গঠন করল। এ সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপের লোকেরা তাদের উপরের ধাপের লোকদের বান্দা বা দাস এবং নীচু ধাপের লোকদের খোদা বনে বসল। তারা আল্লাহর লাখো লাখো বান্দার উপর নির্মম যুলুম নির্যাতন চালাতে লাগল। এ যুলুম আজো অচ্ছুত শ্রেণীর আকারে বিদ্যমান রয়েছে।
তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ করে দিল। তাদের পন্ডিত ও পুরোহিতরা সাপের মত জ্ঞান ভাণ্ডারের চারদিক বেষ্টন করে বসে রইল। তাদের উপরের তলার কর্তারা দেশের জনসাধারণের উপর নিজেদের বহু অন্যায় অধিকার চাপিয়ে দিল। এ অধিকার আদায় করা এবং আরাম কেদারায় বসে বসে অন্যের পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে বিলাসী জীবন যাপন করা ছাড়া তাদের আর কোন কাজ রইলো না। এহেন পরিস্থিতিতে আল্লাহ্ তাদের কাছ থেকে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মধ্য এশিয়ার কতিপয় জাতিকে এখানে পরিচালনার সুযোগ দিলেন। এ জাতিগুলো সে সময় ইসলামী আন্দালনের সংস্পর্শে এসে জীবন যুদ্ধের উন্নততর যোগ্যতা অর্জন করেছিল।
কয়েক'শ বছর তারা এদেশ পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিল। এ দেশেরও বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে তাদের সাথে মিশে গিয়েছিল। অবশ্যি তারাও অনেক কিছু ধ্বংস করেছে। কিন্তু যে পরিমাণ ধ্বংস করেছে, তার চেয়ে বেশী সৃষ্টি করেছে। কয়েক'শ বছর পর্যন্ত ভারতবর্ষে যত গঠনমূলক কাজ হয়েছে তা সবই তাদের দ্বারা অথবা তাদের প্রভাবে সম্পাদিত হয়েছে। তারা দেশে জ্ঞানের আলো বিতরন করেছে। চিন্তা ও ভাবধারা পরিশুদ্ধ করেছে। সমাজ, তামাদ্দুন ও সভ্যতার অনেক কিছু সংশোধন করেছে, দেশের উপায়-উপাদানকে সে যুগের উপযোগী করে কল্যাণের পথে ব্যবহার করেছে। সর্বোপরি তারা শান্তি ও সুবিচারের এমন সুষ্ঠু ব্যবস্থা কায়েম করেছিল যা ইসলামের সত্যিকার শান্তি ও সুবিচার থেকে অনেক নিন্মমানের হলেও ইতিপূর্বেকার এবং আশপাশের দেশগুলোর অবস্থার তুলনায় অনেক খানি ঊঁচুস্তরের ছিল। অতঃপর তারাও পূর্ববর্তীদের ন্যায় পথভ্রষ্ট হতে লাগল এবং তাদের মধ্যেও গঠনমূলক কাজের যোগ্যতা কমে যেতে লাগল এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের প্রতি ঝোঁক প্রবণতা বেড়ে চলল। তারাও উঁচু-নীচু, বংশ মর্যাদার শ্রেণী বিভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের সমাজ ও জাতিকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলল। এজন্য চারিত্রিক, রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে। তারাও ইনসাফের তুলনায় যুলুম, নির্যাতন অনেক বেশী করতে লাগল। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে গিয়ে তারা শুধু তাত্থেকে স্বার্থসিদ্ধি এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে অবৈধ স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টায় মেতে উঠল। উন্নতি ও সংস্কারমূলক কাজ ছেড়ে দিয়ে তারাও আল্লাহ্ প্রদত্ত শক্তি ও উপায় উপাদান নষ্ট করতে এবং সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে ব্যবহার করতে লাগল। দৈহিক আরাম ও ভোগ লালসায় তারা এতই মত্ত হয়ে গেল যে, তাদের শাসন কর্তাদেরকে যখন দিল্লীর লাল কেল্লা থেকে পলায়ন করতে হয়েছিল, তখন তাদের শাহজাদারা-যারা গতকাল পর্যন্ত সিংহাসনের দাবীদার ছিল-নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য পলায়ন করতেও পারেনি। কেননা মাটির উপর দিয়ে চলার অভ্যাস তারা পরিত্যাগ করেছিল। মুসলমানদের সাধারণ নৈতিক চরিত্রের চরম অধঃপতন হয়েছিল। একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় বড় হোমরা চোমরা দায়িত্বশীল লোকদের পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুরই পরোয়া ছিল না। ফলে ধর্ম, জাতি ও দেশকে অন্যের হাতে বিকিয়ে দেয়ার পথে তাদেরকে বাধা দেয়ার মতো আর কিছুই রইল না। তাদের মধ্যে জন্ম নিলো লাখো লাখো পেশাদার সিপাই। এদের নৈতিক চরিত্র ছিল পোষা কুকুরের মতো। যে কেউ খাবার দিয়ে এদেরকে পুষতে পারত এবং তারপর এদের দিয়ে ইচ্ছামত শিকার করাতে পারত। এদের মধ্যে এই অনুভূতি ছিলনা যে, এই ঘৃণ্য পেশার বদৌলতেই শত্রুরা তাদের সাহায্যে তাদেরই জয় করেছে -এর একটি জঘন্যতম দিক আছে। গালিবের মতো কবিও এ সম্পর্কে গর্ব করে বলেছনঃ "শত পুরুষ থেকে বাপ দাদার পেশা হলো সৈনিক বৃত্তি।" এতবড় একজন কবি একথা বলার সময় এতটুকুও ভাবতে পারেননি যে, পেশাধারী সৈনিকবৃত্তি গর্বের বিষয় নয়; লজ্জায়মরে যাবার জিনিস।
মুসলমানেরা যখন এহেন অবস্থায় পৌঁছল, তখন আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমতাচু্যত করার সিদ্ধান্ত করলেন এবং গোটা ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা আবার নতুন প্রার্থীদের হাতে যাওয়ার সুযোগ এলো। এ সময় দেশে মারাঠা, শিখ, ইংরেজ ও কতিপয় মুসলমান নেতা এই চারজন প্রার্থীকে দেখা যাচ্ছিল। জাতীয়তাবাদের নেশা ও স্বজাতির প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব থেকে মন ও মগযকে মুক্ত ও পবিত্র রেখে ন্যায়ভাবে তখনকার ইতিহাস ও পরবর্তী অবস্থা পর্যালোচনা করলে আপনার বিবেক একথা স্বীকার করবে যে, তখন গঠনমূলক কাজের যে যোগ্যতা ইংরেজদের ছিল তা অন্যকোন প্রার্থীর ছিল না এবং ইংরেজদের ভেতর যে পরিমাণ ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল তার চেয়ে ঢের বেশী ছিল মারাঠা, শিখ ও মুসলমান প্রার্থীর ভেতর। ইংরেজরা যা কিছু গঠনমূলক কাজ করেছে তা অন্যান্য জাতিরা করত না। তারা যা কিছু নষ্ট করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশী অন্যেরা নষ্ট করত। সাধারণভাবে দেখলে ইংরেজদের ভেতর বহু দিক দিয়ে অগণিত দোষ ও অন্যায় পাওয়া যাবে। কিন্তু তুলনা মূলকভাবে বিচার করলে তাদের সমকালীন প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে তাদের অন্যায় অত্যাচার অনেক কম এবং গুণ-গরিমা বেশী পাওয়া যাবে। এই জন্যই তো আল্লাহর আইন আরেকবার মানুষের মনগড়া নীতির মূলোচ্ছেদ করলো। মানুষ বিনা অধিকারে এই নীতি রচনা করেছিল যে- "প্রত্যেক দেশের অধিবাসীগণ সে দেশের মালিক, তারা তাদের ইচ্ছামত দেশকে গড়তেও পারে, ভাঙ্গতেও পারে।" আল্লাহর আইন ইতিহাসের এই চিরন্তন ফয়সালা থেকে প্রমাণ করেছে যে- না, দেশ এক মাত্র আল্লাহর, এর পরিচালনার ভার কাকে দেয়া হবে এ ফয়সালা তিনিই করবেন, এ ফয়সালা কোন বংশ, জাতি অথবা পিতা-প্রপিতার অধিকারের ভিত্তিতে হয় না। বরং কোন্ কোন্ পরিচালনায় সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে, সে দিকে নজর রেখেই এ ফয়সালা গৃহীত হয়।
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ. - سورة آل عمران26
"বলুন, হে আল্লাহ্! দেশের মালিক! তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে রাজ্য দিয়ে থাক এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নিয়ে থাক এবং যাকে চাও তাকে সম্মান এবং যাকে চাও লাঞ্ছনা দিয়ে থাক। তোমারই হাতে রয়েছে সব মঙ্গল। তুমি নিঃসন্দেহে সব কিছু করার ক্ষমতা রাখ।" [সূরা আলে ইমরানঃ ২৬]
এভাবেই হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে একটি জাতিকে আল্লাহ্ এ দেশে নিয়ে এলেন। এরা এ দেশে সংখ্যায় তিন চার লাখের বেশী কোন সময়ই ছিল না। কিন্তু এরা এখানকার উপায়-উপাদান ও মানুষ দিয়ে এ দেশের হিন্দু, মুসলমান, শিখ ইত্যাদি সমস্ত শক্তিকে পরাজিত করে দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করল। এ দেশের কোটি কোটি অধিবাসী এ মুষ্টিমেয় ইংরেজদের অধীন হয়ে রইল। একজন ইংরেজ একাই একটি জেলা শাসন করেছে। তাও এমন অবস্থায় যে, এ কাজে তার হাত শক্তিশালী করার মতো তার জাতির কোন লোক এখানে ছিল না। এসময় এ দেশের লোকেরা যা কিছু করেছে তা সবই চাকর হিসেবে করেছে- কার্যকারক হিসেবে নয়। ইংরেজদের শাসনামলে এ দেশে যেসব গঠনমূলক ও উন্নয়ণমূলক কাজ হয়েছে, তা তাদের দ্বারা এবং তাদের প্রভাবেই হয়েছে- এ কথা আমাদের সবাইকে স্বীকার করতে হবে। অস্বীকার করলে সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হবে। তারা যে অবস্থায় এদেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েছিল, তার তুলনায় আজকের অবস্থা দেখলে এ কথা স্বীকার করার জো নেই যে, তাদের অনিষ্টকারিতা সত্ত্বেও অনেক গঠনমূলক ও উন্নয়ণমূলক কাজ হয়েছে। এসব কাজ এদেশবাসীর দ্বারা সম্পন্ন হওয়ার কোন আশাই ছিল না। এ জন্যই তো আল্লাহ্ আঠার'শ শতাব্দীর মাঝখানে এ দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তা মোটেই ভুল ছিল না।
এখন দেখুন, ইংরেজরা যা কিছু গড়তে পারত তা গড়েছে আর বিশেষ কিছু তাদের দ্বারা গড়ে উঠতে পারে না। এখন তারা যা গড়তে পারে তা অন্যের দ্বারাও সম্ভব। ওদিকে তাদের ধ্বংসকারিতার বহর খুব বেড়ে গেছে। আর যতদিন তারা এ দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে, ততদিন গড়ার চেয়ে ভাঙ্গবেই বেশী। তাদের অন্যায় ও অপরাধের ফিরিস্তি এত দীর্ঘ হয়েছে যে, তা এক বৈঠকে বর্ণনা করা মুশকিল। আর সেগুলো বর্ণনা করার কোন প্রয়োজনও নেই। কারণ, সেসব সবার চোখের সামনেই রয়েছে। তাদেরকে এখন এ দেশের শাসন ক্ষমতা থেকে বেদখল করাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত। তারা নিজেরাই সোজাভাবে এ দেশ থেকে বিদায় নিতে প্রস্তুত হয়ে বেশ বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।
সোজাভাবে না গেলে বাঁকাভাবে তাড়িয়ে দেয়া হতো। কারণ, আল্লাহর চিরন্তন আইন এখন আর তাদের হাতে এ দেশের শাসন ক্ষমতা রাখার পক্ষপাতি নয়।
দুনিয়ার প্রকৃত মালিক কোন দেশে এক প্রকার পরিচালনা ব্যবস্থা খতম করে অন্য প্রকার ব্যবস্থা কায়েম করার ব্যবস্থা করলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, আমরা এখন তারই দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে আছি। এটা ইতিহাসের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাহ্যদৃষ্টিতে এ দেশে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে দেখা যাচ্ছে তাতে কেউ যেন এ প্রতারণায় না পড়েন যে, দেশের শাসনক্ষমতা দেশবাসীর হাতে দেয়ার এই যে সিদ্ধান্ত হচ্ছে তা একেবারে চূড়ান্ত ও চিরন্তন। বর্তমান পরিস্থিতির একটা সহজসাধ্য রূপ হয়তো আপনারা অনায়াসেই অনুধাবন করতে পারছেন যে, বিদেশ থেকে এসে যারা এ দেশ শাসন করছিল, এখন তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। কাজেই এখন স্বাভাবিকভাবেই দেশের ক্ষমতা দেশবাসীর হাতে আসাই উচিত। আসলে কিন্তু তা নয়। আল্লাহর সিদ্ধান্ত এরূপ হয় না। তিনি এই বিদেশীদেরকে পূর্বেও অকারণে আনেননি, আবার এখনো বিনা কারণে সরিয়ে দিচ্ছেন না। পূর্বে যেমন তিনি আপনাদের কাছ থেকে খামখেয়ালীভাবে শাসনক্ষমতা কেড়ে নেননি, তেমনি এখনো আপনাদেরকে খামখেয়ালীভাবে এ ক্ষমতা দেবেন না। আসল ব্যাপার এই যে, বর্তমানে ভারতবাসীরা ক্ষমতার প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছে; হিন্দু, মুসলমান, শিখ সবাই প্রার্থী। যেহেতু এরাই দেশে প্রথম থেকে বসবাস করে আসছে, কাজেই তাদেরকেই প্রথম ক্ষমতা লাভের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা স্থায়ী নিযুক্তি নয়, বরং তাদের পরীক্ষার জন্যই এ সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যদি তারা নিজেদের কার্যকলাপে প্রমাণ করে যে, ভাঙ্গার চেয়ে গড়ার যোগ্যতাই বেশী, তাহলে তাদেরকে এ দেশের শাসন ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করা হবে। আর যদি তারা গঠনমূলক কাজের চেয়ে ধ্বংসাত্মক কাজই বেশী করে, তবে তার পরিণাম খুব শিগগিরই ভোগ করবে। এ অবস্থায় তাদের কাছ থেকে এ দেশের শাসনক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অন্য কোন জাতিকে এ কাজের জন্য নির্বাচিত করা হবে। অতঃপর আর তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই করতে পারবে না। সমগ্র দুনিয়ার সম্মুখে নিজেদের অযোগ্যতার স্পষ্ট প্রমাণ দেয়ার পর তারা কোন মুখে অভিযোগ করবে ? নাছোড়বান্দা হয়ে অনুনয় বিনয় করলেও তা শুনবেই বা কে ?
এখন আপনারা একটু পর্যালোচনা করে দেখুন যে, এ দেশের হিন্দু-মুসলমান ও শিখ এ পরীক্ষায় আল্লাহর সামনে নিজেদের এমন কি যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, গুণ-গরিমা এবং কার্যকলাপ পেশ করেছেন যে, তার ফলে আল্লাহ্ তাঁর দেশের শাসন ক্ষমতা আবার তাদের হাতে সোপর্দ করবেন বলে তারা আশা করতে পারেন। হিন্দু, মুসলমান ও শিখদের অপরাধগুলো নৈতিকতার আদালতে পেশ করলে তারা সবাই দোষী সাব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি যদি এখন নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সুস্পষ্টভাবে সেগুলো বলে দেই, তাহলে আশা করি আপনারা খারাপ মনে করবেন না। নিজের জাতি ও স্বদেশী ভাইদের দোষ বর্ণনা করা আমারও ভাল লাগে না। আসলে আমার হৃদয় এতে কাঁদে। কারণ, আমি তাদের এ সমস্ত দোষ ও অপরাধের মারাত্নক পরিণাম যেন স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। তাদেরকে শিগ্গিরই এ পরিণামের সম্মুখীণ হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এসব দোষ ও অপরাধ তাদেরকে ধ্বংস করবে বলে আমার আশংকা হচ্ছে। আমি, আপনি কেউই এ মারাত্মক পরিণাম থেকে বাঁচতে পারবো না। এজন্য আমি অন্তরের বেদনা নিয়ে এগুলো বিবৃত করছি। এর ফলে যার কান আছে সে শুনে সংশোধনের কিছুটা চিন্তা করতে পারবে।
আমাদের দেশবাসীর সাধারণ নৈতিক চরিত্রের অবস্থা যে রকম হয়েছে তা আপনারা নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অনুযায়ী অনুমান করে দেখুন। আমাদের ভেতর শতকরা ক'জন সত্যিকার চরিত্রবান লোক আছে ? কারোর অধিকার হরণ করা, কোন অবৈধ স্বার্থসিদ্ধি, কোন 'লাভজনক' মিথ্যা বলা এবং কোন 'লাভজনক' বিশ্বাস-ঘাতকতা করা নৈতিক দৃষ্টিতে খারাপ -শুধু এই কারণে আমাদের ক'জন এসব কাজ করতে ইতস্তত করে থাকে? যেখানে আইনের বাঁধন নেই অথবা যেখানে আইনের আওতা থেকে বাঁচবার আশা ও পথ আছে, সেখানে শতকরা ক'জন শুধু নিজের নৈতিক অনুভূতির বলে অন্যায় ও অপরাধ থেকে বিরত থাকে? যেখানে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের আশা না থাকে, সেখানে ক'জন অন্যের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে। এরূপ ক্ষেত্রে ক'জন অপরের দুঃখে-দৈন্যে মনে ব্যাথা পায় এবং স্বার্থ ত্যাগ করে? নিস্বার্থভাবে ক'জন অপরের হক আদায় করে? ক' জন ব্যবসায়ী ধোঁকা-ফাঁকি, মিথ্যা, মুনাফাখোরী, অন্যায়ভাবে উপার্জন করা থেকে বিরত থাকে? ক'জন শিল্পপতি নিজের স্বার্থের সঙ্গে ক্রেতাদের স্বার্থ এবং নিজের জাতি ও দেশের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রাখে? খাদ্যশস্য মজুদ রেখে অত্যাধিক চড়া দরে বিক্রি করতে গিয়ে ক'জন জমিদার একটু ভেবে দেখে যে, তারা এ মুনাফাকারীর দ্বারা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষকে ভূখা রেখে অসহ্য যন্ত্রনা দিচ্ছে? ক'জন ধনী ব্যক্তি ধন উপার্জনে অন্যায়, অত্যাচার, অধিকার হরণ ও বিশ্বাস ঘাতকতা থেকে মুক্ত রয়েছে? আমাদের দেশের শ্রমজীবি দের মধ্যে ক'জন সঠিকভাবে কর্তব্য পালন করে তাদের বেতন ও পারিশ্রমিক গ্রহণ করে? ক'জন সরকারী কর্মচারী ঘুষ, আমানত খেয়ানত, অত্যাচার, উৎপীড়ন, কর্তব্যে অবহেলা, হারাম খাওয়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকে? উকিল, চিকিৎসক, সাংবাদিক, গ্রন্থকার, প্রকাশক, জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক ও নেতৃবৃন্দের ক'জন নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য অসৎ ও ঘৃন্য পন্থা অবলম্বন করে না? এদের ক'জন মানুষের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আর্থিক ক্ষতি সাধনে কিছু মাত্র লজ্জা বোধ করে? বড় জোর দেশের শতকরা মাত্র পাঁচজন এসব নৈতিক রোগ থেকে মুক্ত রয়েছে, আমার মনে হয় একথা মোটেই অতু্যক্তি নয়। বাকী পঁচানব্বই জনই এই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত। এ ব্যাপারে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খৃষ্টান প্রভৃতির ভেতর কোন পার্থক্য নেই। সবাই সমানভাবে রোগাক্রান্ত। সবারই নৈতিক অবস্থার চরম ও ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। কোন জাতির অবস্থাই অন্য জাতির চেয়ে ভাল নয়।
অধিকাংশ লোক এরূপ নৈতিক অধঃপতনের কবলে পড়ায় সমষ্টিগত ভাবে এই নৈতিক রোগের ব্যাপক প্রসার হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। গত মহাযুদ্ধের কারণে যখন রেল গাড়ীতে যাত্রীদের ভীড় হতে লাগলো তখন এই সম্ভাব্য তুফানের প্রথম লক্ষণ দেখা দিল। সেখানে একই জাতির ও একই দেশের লোকেরা পরস্পরের সঙ্গে যে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতামূলক ব্যবহার করেছে, তা থেকেই টের পাওয়া গিয়েছিল যে, কেবল দ্রুতগতিতে আমাদের সাধারণ নৈতিক চরিত্রের অবনতি ঘটেছে। এরপর প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের অভাব ও উচ্চমূল্যের সময় মাল মজুদ রাখা এবং চোরাবাজারী ব্যাপক ভাবে শুরু হয়। অতঃপর দেখা দিল বাংলাদেশের সেই ভয়াবহ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। এই দুরাবস্থার সময় দেশের এক সমপ্রদায় নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য নিজেদের দেশের লাখো লাখো মানুষকে ভূখা রেখে তিলে তিলে মৃতু্যর দিকে এগিয়ে দিয়েছে। এসব ছিল প্রাথমিক লক্ষণ, এরপর নোংরামি, বর্বরতা, নীচতা, পশুসুলভ আচরণ ইত্যাদির অগি্নকাণ্ড হঠাৎ ফেটে পড়লো। এগুলো এখানকার গভীরে বহুদিন হতে উত্তপ্ত হচ্ছিল। বর্তমানে একটি সামপ্রদায়িক দাঙ্গারূপে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সবকিছু জ্বালিয়ে ছাই করে দিচ্ছে। কলকাতার গোলযোগের পর থেকে হিন্দু, মুসলমান ও শিখদের জাতীয় বিরোধের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনটি জাতিই তাদের জঘন্য চরিত্রের প্রদর্শনী করে বেড়াচ্ছে।
যে সমস্ত কাজ কোন মানুষ করতে পারে বলে ধারণাও করা যেত না, তা আজ আমাদের দেশবাসীরা প্রকাশ্যে করে যাচ্ছে। বড় বড় অঞ্চলের প্রায় সমস্ত লোক গুন্ডায় পরিণত হয়েছে। গুন্ডারা যে কাজ করার ধারণাও কোন দিন করেনি তাও এখন তারা করছে। দুগ্ধ-পোষ্য শিশুদের মায়ের বুকের উপর রেখে জবাই করা হয়েছে, জীবন্ত মানুষদেরকে আগুনে জ্বালানো হয়েছে। ভদ্র মহিলাদের হাজার হাজার লোকের সামনে উলঙ্গ করে তাদের উপর প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। পিতা, ভাই ও স্বামীর সামনে তাদের মেয়ে, বোন ও স্ত্রীর শ্লীলতা হানি করা হয়েছে। মসজিদ, মন্দির ও ধর্মীয় গ্রন্থরাজির উপর ক্রোধ প্রকাশ করতে গিয়ে অত্যন্ত পৈশাচিক উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। রুগ্ন, আহত ও বৃদ্ধাদেরকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। পথিক যাত্রীদেরকে চলন্ত গাড়ী থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। জীবন্ত মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কর্তন করা হয়েছে। নিরীহ ও অক্ষম লোকদেরকে জন্তু-জানোয়ারের মতো শিকার করা হয়েছে। প্রতিবেশী ও প্রতিবেশীর গৃহ লুট-তরায করেছে। বন্ধুর প্রতি বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আশ্রয় দাতা আশ্রয় দিয়ে নিরাশ্রয় করেছে। শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষকগণ (পুলিশ, সৈন্য ও ম্যাজিষ্ট্রেটগণ) প্রকাশ্যে দাঙ্গায় অংশ গ্রহণ করেছে এমনকি তারা নিজেরাই দাঙ্গা করেছে এবং নিজেদের সাহায্য সহানুভূতি ও তত্ত্বাবধানে দাঙ্গা বাধিয়েছে। মোটকথা, অত্যাচার, অনাচার, নিষ্ঠুর ও নির্দয় ব্যবহার, বর্বরতা ও জঘন্য কার্যকলাপ ইত্যাদির কোন কিছু আর বাকী নেই, যা এ কয়েক মাসের ভেতর আমাদের দেশের লোকেরা সমষ্টিগতভাবে করেনি। তবুও মনের জ্বালা মেটেনি। আলামত যা দেখা যাচ্ছে, মনে হয় এর চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ ও বিরাট আকারে দাংগা এখন দেখা দেবে।
আপনারা কি মনে করেন, এসব কিছুই একটা আকস্মিক উত্তেজনার ফল মাত্র। এরূপ ধারনা করে থাকলে আপনারা বিরাট ভুলের মধ্যে আছেন বলতে হবে। এই মাত্র আমি আপনাদের বলেছি যে, এ দেশের শতকরা পঁচানব্বই জন নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। দেশের জন সমষ্টির এত বিরাট অংশ যদি অসৎ চরিত্রের হয়ে পড়ে তা হলে জাতির সমষ্টিগত স্বভাব চরিত্র কেমন করে ঠিক থাকতে পারে? এই জন্যই তো হিন্দু-মুসলমান ও শিখ জাতির কাছে সত্যবাদিতা, সুবিচার ও সততার কোন দামই এখন নেই। সত্যপন্থী, সৎ এবং ভদ্রস্বভাব বিশিষ্ট লোকেরা তাদের ভিতর কোনঠাসা ও দুর্বল হয়ে রয়েছে। মন্দ কাজে বাধা দান এবং ভাল কাজ করার জন্য উপদেশ দেয়া তাদের সমাজে অসহনীয় অপরাধে পরিণত হয়েছে, সত্য ও ন্যায় কথা শুনতে তারা প্রস্তুত নয়।
তাদের মধ্যে একটি জাতিই এমন লোকদেরকে পছন্দ করে যারা তার সীমাহীন লোভ লালসা ও স্বার্থের পক্ষে ওকালতি করে এবং অন্যের বিরুদ্ধে তাকে উত্তেজিত করে তার ন্যায় ও অন্যায় সবরকম স্বার্থোদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করতে প্রস্তুত হয়। এজন্যই এরা নিজেদের ভিতর থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে দুষ্ট প্রকৃতির লোকদেরকে নিজেদের নেতা নির্বাচন করেছে। তারা নিজেদের জঘন্যতম অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করে তাদেরকে নিজেদের নেতৃত্ব পদে বরণ করে নিয়েছে। তাদের সমাজে সবচেয়ে দুশ্চরিত্র, দূর্নীতিবাজ, বিবেকহীন লোকেরা তাদের মুখপাত্র সেজে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অত্যাধিক বরণীয় হয়েছে। অতঃপর এসব লোকেরা নিজ নিজ পথভ্রষ্ট জাতিকে নিয়ে ধ্বংসের পথে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। তারা জাতির পরস্পর বিরোধী আশা-আকাংখাকে কোন ইনসাফের কেন্দ্রবিন্দুতে একত্রিত না করে তাকে এতখানি বাড়িয়ে দিয়েছে যে, তা অবশেষে সংঘর্ষের সীমান্তে পৌঁছেছে। তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘর্ষে ক্রোধ, ঘৃণা, শত্রুতার বিষ মিশিয়ে একে নিত্য অগ্রবর্তী করেছে। বহু বছর ধরে নিজেদের প্রভাবাধীন জাতিগুলোকে উত্তেজনামূলক বক্তৃতা ও রচনার ইনজেকশন দিয়ে এতখানি উত্তেজিত করে তুলেছে যে, এখন উত্তেৎনাবশতঃ কুকুর ও হিংস্র পশুর মত লড়াই করবার জন্য খড়গ উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজের মনকে পৈশাচিক আবেগ ও উচ্ছাসে দূর্গন্ধময় এবং অন্ধ শত্রুতার চুল্লীবানিয়ে ফেলেছে। আপনাদের সামনে এখন যে তুফান প্রবাহিত হচ্ছে তা মোটেই সাময়িক ও আকস্মিক নয়। বহুদিন থেকে বিকৃতির যেসব বেশুমার কার্যকারণ আমাদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে এ হলো তারই স্বাভাবিক পরণতি। এটা একবার দেখা দিয়েই ক্ষান্ত হবে না; বরং যতদিন পর্যন্ত এসব কার্যকারণ সক্রিয় থাকবে, ততদিন এ বিকৃতি ক্রমশ বাড়তে থাকবে। এটা একটা শস্যপূর্ণ ক্ষেতের মত। বহু বছরের বীজ বপন ও জল সেচের পর এ ফসল খাবার উপযুক্ত হয়েছে। এখন আপনাকে এবং আপনার বংশধরদেরকে কতদিন পর্যন্ত এ ফসল কাটতে হবে তা বলা যায় না।
সমবেত ভদ্রমন্ডলী ও মহিলাবৃন্দ!
যে আল্লাহ্ এই দুনিয়াকে সৃষ্টি করে পৃথিবী পৃষ্ঠকে বিছানার মতো করে তৈরী করেছেন এবং তার উপর মানুষের বসবাস করার সুব্যবস্থা করেছেন, তিনি অন্ধের মতো আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে কোন কাজ করেন না। কোন কিছু না দেখেশুনে অন্ধকারে হাতড়িয়ে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেবার মতো বাদশাহ তিনি নন। তাঁর নিজস্ব আইন-কানুন, বলিষ্ঠ নিয়ম-নীতি, সুদৃঢ় ব্যবস্থা ও সুষ্ঠু কর্মপদ্ধতি রয়েছে। তদনুযায়ী তিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের উপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব করছেন। পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, পানি, বাতাস, বৃক্ষ, পশু-পাখি ইত্যাদির মতো আমরা গোটা মানব জাতিও তাঁর প্রাকৃতিক আইন ও নিয়মের অধীনে সুসংবদ্ধ। আমাদের জন্ম ও মৃতু্য, আমাদের শৈশব, আমাদের যৌবন ও বার্ধক্য, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের পাকস্থলী ও রক্ত চলাচল, আমাদের সুস্থতা ও অসুস্থা ইত্যাদি সব কিছুর উপরই তাঁর চিরন্তন প্রাকৃতিক আইন ও নিয়মের কর্তৃত্ব একটানাভাবে রীতিমত চলছে। এছাড়া তাঁর আর একটা আইনও রয়েছে। সেটা তাঁর প্রাকৃতিক আইনের মতই আমাদের ইতিহাসে উঠা-নামা, আমাদের উত্থান-পতন, আমাদের উন্নতি-অবনতি এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত -তথা দেশ ও জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের উপর কর্তৃত্ব করছে। আল্লাহর প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নাকের বদলে চোখের সাহয্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করা এবং পেটের বদলে হৃদয়ে খাদ্য হজম করা যদি মানুষের পক্ষে সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে যে পথে চললে আল্লাহর আইন অনুযায়ী কোন জাতির অধপতন হওয়া উচিত, সেই পথে তার উন্নতি হওয়া সম্বব নয়। আগুন যেমন একজনের জন্য গরম এবং আরেক জনের জন্য ঠান্ডা নয়, তেমনি আল্লাহর আইন অনুযায়ী যে সমস্ত কাজ খারাপ তা একজনকে অবনত এবং অন্য জনকে উন্নত করতে পারে না। মানুষের ভাল-মন্দের জন্য আল্লাহ্ যে নিয়ম-নীতি নির্ধারিত করেছেন, তা কারোর চেষ্টায় পরিবর্তিত ও বাতিল হতে পারে না। তার ভেতর কারো সঙ্গে শত্রুতা এবং কারো সঙ্গে স্বজনপ্রীতিও নেই। আল্লাহর এই আইনের সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে এই যে, তিনি গড়া পছন্দ করেন এবং ভাঙ্গা পছন্দ করেন না। সব কিছুর মালিক হিসেবে তিনি তাঁর দুনিয়াকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে চান। একে অতিমাত্রায় সুসজ্জিত করতে চান। তাঁর যাবতীয় উপায় উপাদান এবং শক্তি ও যোগ্যতাকে সুষ্ঠু পন্থায় সদ্ব্যবহার করতে চান। তিনি কখনও তাঁর দুনিয়ার ধ্বংস ও অনিষ্ট সাধন করেন না। বিশৃংখলা, কুকর্ম, অত্যাচার ও অনাচার করে তাঁর দুনিয়াকে শ্রীহীন সৃষ্টিতে পরিণত করাকে তিনি কোনদিন পছন্দ করবেন বলে আশাও করা যেতে পারে না। যে সমস্ত লোক দুনিয়া পরিচালনার ক্ষমতা লাভ করতে চায় তাদের ভেতর থেকে কেবলমাত্র তারাই আল্লাহর দৃষ্টিতে যোগ্যতাসম্পন্ন হয়; যারা এ দুনিয়াকে গড়বার যোগ্যতা অন্যদের চেয়ে বেশী রাখে। এরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদেরকেই তিনি দুনিয়া পরিচালার দায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন।
অতঃপর এসব ক্ষমতাসীন লোকেরা কতটুকু ভাঙ্গে এবং কতটুকু গড়ে -সেদিকে তিনি তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ভাঙ্গার চেয়ে গড়তে থাকে বেশী এবং তাদের চেয়ে বেশী গড়ে কম ভাঙ্গে -এমন কেউ কর্মক্ষেত্রে থাকে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ তাদের সমস্ত দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও দুনিয়া পরিচালনার ক্ষমতা তাদের হাতেই রাখেন। কিন্তু যখন তারা গড়ে কম এবং ভাঙ্গে বেশী, তখন আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমতাচু্যত করে অন্য লোকদেরকে ঐ একই শর্তে ক্ষমতা দিয়ে থাকেন।
এটা একটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আইন। আপনাদের বিচার বুদ্ধিও প্রমাণ করবে যে, আইনটি এমনই হওয়া উচিত। যদি আপনাদের কারোর একটি বাগান থাকে এবং তিনি একজন মালীকে তার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করেন, তাহলে আপনি নিজেই বলুন, তিনি ঐ মালীর নিকট সর্বাগ্রে কি আশা করতে পারেন? তিনি অবশ্যি নিজের বাগানের ক্রমোন্নতি চাইবেন। তার শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শোভা-সৌন্দর্য এবং উৎপাদন বৃদ্ধিই হবে তার কাম্য। যে মালীকে তিনি দেখবেন অত্যন্ত প্ররিশ্রম, যোগ্যতা ও মনোযোগ সহকারে সুনিপুণভাবে বাগানের সেবা যত্ন করছে, বাগানের সাজসজ্জার দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখছে, তার চেষ্টা ও যত্নে ভাল দরকারী গাছগুলো বেশ সতেজ ও সুন্দর হচ্ছে, সে আগাছা, আবর্জনা ও বন-জঙ্গল পরিষ্কার করছে তার সুরুচি ও শিল্প শক্তি দিয়ে উৎকৃষ্ট ও নতুন ফল-মূল এবং ফুলের উৎপাদন বৃদ্ধি করছে- তার উপর তিনি অবশ্যই সন্তুষ্ট হবেন। তিনি তাকে ভালবাসবেন এবং উচ্চ মর্যাদা দেবেন। এমন উপযুক্ত, কর্তব্যপরায়ণ, পরিশ্রমী, অনুগত ও সুযোগ্য মালীকে তাড়িয়ে দেয়া তিনি কোন দিনই পছন্দ করবেন না। কিন্তু এ না হয়ে যদি ঠিক এর উল্টোঁাই হয় অর্থাৎ, যদি তিনি দেখেন যে, মালী অযোগ্য-অপদার্থ, আলসে ও ফাঁকিবাজ, সে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে বাগানের ক্ষতি করছে, গোটা বাগানটা আবর্জনা ও বন-জঙ্গলে ভরে গিয়েছে, গাছের পাতা ও ডালগুলো ভেঙে পড়েছে, কোথাও বিনা প্রয়োজনে পানি বয়ে যাচ্ছে, আবার কোথাও পানির অভাবে মাটি ও গাছপালা সব শুকিয়ে যাচ্ছে, ঘাস, আগাছা, বনজঙ্গল ও আবর্জনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, ফুল ও ফলবান গাছগুলোকে অকাতরে কেটে কেটে ফেলে দেয়া হচ্ছে, ভাল ভাল গাছগুলো মরে গিয়ে আগাছায় বাগান ভরে যাচ্ছে, তাহলে বলুন, বাগানের মালিক এমনতর মালীকে কি করে পছন্দ করতে পারে? কোন সুপারিশ, কাকুতি-মিনতি, সবিনয় নিবেদন ও প্রার্থনা এবং উত্তরাধিকার ও মনগড়া অধিকারের দরুন মালিক তার বাগানের দায়িত্বভার এমন অযোগ্য মালীর উপরই ন্যস্ত রাখবে? বড় জোর এতটুকু হতে পারে যে, সে মালীকে শাসিয়ে দিয়ে আর একবার তাকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেবে। কিন্তু যে মালীর কোন শাসনেই চৈতন্য হয় না এবং ক্রমাগত বাগানের ক্ষতিই করতে থাকে, তাকে কান ধরে বের করে দিয়ে অন্য কোনো ভাল মালী নিযুক্ত করা ছাড়া মালিকের পক্ষে এ সমস্যার আর কি সমাধান হতে পারে?
যদি নিজের সামান্য একটা বাগান পরিচালনার ব্যাপারেও আপনি অনুরূপ পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। তাহলে চিন্তা করে দেখুন যে, আল্লাহ্ তাঁর এতবড় ভূমন্ডলটা এত সব উপায়-উপকরণসহ মানুষের কর্তৃত্বাধীনে রেখে দুনিয়া ও তার সমস্ত বস্তুর উপর তাকে এত ক্ষমতা ও অধিকার দিয়েছেন, এক্ষেত্রে মানুষ তাঁর দুনিয়াকে সুন্দর করে গড়ে তুলছে, না ধ্বংস করছে, এ বিষয়টা তিনি কি করে উপেক্ষা করতে পারেন? আপনি যদি তাঁর দুনিয়াকে সুন্দর করে গড়তে থাকেন তবুও তিনি আপনাকে ক্ষমতা থেকে অযথা সরিয়ে দেবেন- এমনতর হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু যদি আপনি গঠনমূলক কোন কিছু না করেন এবং আল্লাহর এ বিরাট বাগানখানাকে একেবারে উজাড় ধ্বংস করতেই থাকেন তাহলে আপনার দাবীকে নিজের বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী যতই জোরদার মনে করুন না কেন তিনি তাঁর বাগানে আপনার কোন অধিকারই স্বীকার করবেন না। প্রথমে তিনি আপনাকে শাসিয়ে হুঁশিয়ার করে দেবেন এবং সংশোধনের দু'চারটে সুযোগ দেবেন। পরিশেষে আপানাকে পরিচালকের মর্যাদা থেকে পদচু্যত করেই ছাড়বেন।
এ ব্যাপারে একটা বাগানের মালিকের দৃষ্টিকোণ ও মালীর দৃষ্টিকোণ যেমন বিভিন্ন তেমনি আল্লাহর দৃষ্টিকোণ ও মানুষের দৃষ্টিকোণের মধ্যেও বিভিন্নতা রয়েছে। ধরুন, মালীদের এক পরিবার বংশানুক্রমে একজন লোকের বাগানে কাজ করে আসছে। তাদের পূর্ব পুরুষের কাউকে হয়তো তার যোগ্যতা ও জ্ঞান বুদ্ধির দরুন বাগানে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তার সন্তান-সন্ততিও বাগানের কাজ সুন্দরভাবে করেছিল, তাই বাগানের মালিক চিন্তাকরে দেখলো যে, অযথা এদেরেকে সরিয়ে অন্য মালী নিযুক্ত করার কি দরকার? এরা ও যখন ভালভাবেই কাজ করছে, তখন এদের অধিকার অন্যের চেয়ে বেশী। এভাবে মালীদের এই বংশ স্থায়ীভাবে বাগানে কাজ করতে লাগলো। কিন্তু কিছু কাল পরে এই বংশের মালীরা একেবারে অযোগ্য, অপদার্থ, ফাঁকিবাজ, আলসে, কুঁড়ে ও অবাধ্য হয়ে পড়ল। বাগান পরিচালনার কোন যোগ্যতাই তাদের রইল না। এখন তারা গোটা বাগানটার সর্বনাশ করতে শুরু করেছে, তবুও তদের দাবী এই যে তারা তাদের বাপদাদার আমল থেকে পুরুষানুক্রমে এ বাগানে বাস করে আসছে, তাদের পূর্ব পুরুষদের কারুর দ্বারা এ বাগান গড়ে উঠেছিল, কাজেই এতে তাদের জন্মগত অধিকার রয়েছে এবং তাদেরকে সরিয়ে অন্য কাউকে এ বাগানের পরিচালনার জন্য মালী নিযুক্ত করা কোনক্রমেই সংগত হতে পারে না। এটিই ঐ অযোগ্য ও অপদার্থ মালীদের দৃষ্টিকোণ। কিন্তু বাগানের মালিকের দৃষ্টিকোণও কি অনুরূপ হতে পারে? সে কি একথাই বলবে না_ আমার কাছে তো বাগানের সুন্দর ও সুষ্ঠ পরিচালনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আমি তো মালীদের কোন পূর্ব পুরুষের জন্য এ বাগান করিনি। বরং তাদের পূর্ব পুরুষের কাউকে আমার বাগানের কাজের জন্য চাকর রেখেছিলাম। বাগানে তাদের যা কিছু অধিকার আছে তা যোগ্যতা ও কাজের শর্তাধীন। তারা বাগানকে ঠিকমত গড়ে তুললে তাদের সমস্ত অধিকার বিবেচনা করা হবে। নিজের পুরানো মালীদের সংগে আমার এমন কি শক্রতা থাকতে পারে যে, তারা ভালভাবে কাজ করলেও আমি অযথা তাদেরকে তাড়িয়ে অন্য মালীদেরকে নিযুক্ত করবো? কিন্তু যে বাগানের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তোমাদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছিল সেটিকেই যদি তোমরা নষ্ট ও উজাড় করে ফেল, তাহলে তোমাদের কোন অধিকারই আমি স্বীকার করবো না। অন্য যারা এ কাজ ঠিকমত করতে চায় আমি তাদেরকে বাগান পরিচালনার দায়িত্ব ও ক্ষমতা দান করবো এবং তাদের অধীনে তোমাদের চাকুরি করতে হবে। এতেও যদি তোমরা ঠিক না হও এবং অধীনস্ত হিসেবেও যদি তোমরা অকেজো প্রমাণিত হও; বরং শুধু নষ্ট করতেই থাক, তাহলে আমি তোমাদেরকে এ বাগান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে অন্য মালীদেরকে এখানে নিযুক্ত করবো।
দৃষ্টিকোণের এই পার্থক্য যেমন একটা বাগানের মালিক ও মালীর মধ্যে রয়েছে, তেমনি রয়েছে দুনিয়ার মালিক ও দুনিয়াবাসীদের মধ্যেও। দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন জাতি তাদের আপন আপন এলাকাকে স্বদেশ ভূমি বলে দাবী করে। বংশানুক্রমে তারা এবং তাদের পূর্ব-পুরুষগণ সেখানে বসবাস করে আসছে। তাদের দেশের উপর তাদের কর্তৃত্ব করার জন্মগত অধিকার রয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করে। কাজেই তাদের মতে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা একমাত্র তাদেরই প্রাপ্য। বাইরের আর কারুর সেখানে কর্তৃত্ব করার কোন অধিকার নেই। এ হচ্ছে দুনিয়াবাসীদের দৃষ্টিকোণ। কিন্তু দুনিয়ার আসল মালিক আল্লাহর দৃষ্টকোণ এটা নয়। তিনি কখনো এ সব জাতীয় অধিকার স্বীকার করেননি। প্রত্যেক দেশের উপর তার অধিবাসীদের জন্মগত অধিকার রয়েছে এবং সে অধিকার থেকে তাদেরকে কোনক্রমেই বঞ্চিত করা চলবে না- এমন কোন কথা তিনি স্বীকার করেন না। তিনি তো দেখেন, কোন্ দেশে কোন্ জাতি কি কাজ করছে। যদি কোন জাতি তার দেশে গঠনমূলক কাজে লিপ্ত থাকে, তার সমস্ত শক্তিসামর্থ দুনিয়ার সংশোধন ও উন্নতির জন্য নিয়োগ করে থাকে, সব রকমের মন্দ কাজ প্রতিরোধ করে এবং ভাল কাজের ক্ষেত্র প্রশস্ত করতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে দুনিয়ার মালিক বলেন, অবশ্য তোমরা দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার অধিকারী। তোমরা পূর্ব থেকেই এ দেশে বসবাস করে আসছো এবং দেশ পরিচালনারও যোগ্যতা রাখ। কাজেই অন্যান্য জাতির চেয়ে তোমাদের অধিকারই অগ্রগণ্য। কিন্তু যদি ব্যাপারটা উল্টো হয় অর্থাৎ, যদি গড়ার পরিবর্তে শুধু ভাঙ্গার কাজই হতে থাকে, সৎ কাজের বদলে দেশ জুড়ে কেবল অসৎ ও অবৈধ কাজই সংঘটিত হয় এবং আল্লাহ্ দুনিয়ায় যা সৃষ্টি করেছেন তাকে কোন ভাল কাজে না লাগিয়ে বেপরোয়া ভাবে নষ্ট করা হয়- এক কথায় দেশকে গড়ার বদলে ভেঙ্গে ফেলা হয়- তাহলে আল্লাহ্ এহেন জাতিকে প্রথমে কিছুটা হালকা এবং কিছুটা কঠিন আঘাত দেন, যাতে করে তারা সতর্ক হয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করতে পারে। এতেও যে জাতি ঠিক না হয়, তার কাছ থেকে দেশের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অন্তত এর চেয়ে যোগ্যতর জাতিকে দেয়া হয়।
এখানেই শেষ নয়। যদি পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা পরাধীন হওয়ার পরও কোন যোগ্যতা ও গুণবৈশিষ্ট্যের প্রমাণ না দেয় এবং কার্যকলাপের মাধ্যমে এ কথাই প্রমাণ করে যে, বিকৃতি করা ছাড়া তাদের দ্বারা আর কোন কাজই হবে না, তাহলে এহেন জাতিকে আল্লাহ্ নিশ্চিহ্ন করে দেন। তারপর তাদের স্থানে অন্য কোন জাতিকে আনেন। এ ব্যাপারে সব সময়ই মালিকের যে দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত, আল্লাহরও তাই হয়ে থাকে। তিনি তাঁর দুনিয়া পরিচালনার ক্ষেত্রে দাবীদার ও প্রার্থীদের উত্তরাধিকার অথবা জন্মগত অধিকার দেখেন না। তিনি দেখেন কার গড়ার যোগ্যতা বেশী এবং ভাঙ্গার দিকে ঝোঁক প্রবনতা কম রয়েছে। একই সময়ের প্রার্থীদের মধ্যে যারা এ দিক দিয়ে যোগ্যতর বলে প্রমাণিত হয়, তাদেরকেই দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করা হয়। যতদিন এদের ধ্বংসাত্মক কাজের চেয়ে গঠনমূলক কাজ বেশী হতে থাকে অথবা এদের তুলনায় বেশী ভাল করে গঠনমূলক কাজ করে এবং ধ্বংসাত্মক কাজও কম করে- এমন কেউ এগিয়ে না আসে- ততদিন দেশ পরিচালনার ক্ষমতা এদের হাতেই রাখা হয়।
এসব যা কিছু আমি বলছি, ইতিহাসে এর জ্বলন্ত প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ্ চিরকালই এ নীতি অনুযায়ী তাঁর দুনিয়া পরিচালনার ব্যবস্থা করছেন। দূর দেশের কথা না হয় ছেড়েই দিন। নিজেদের এ দেশের ইতিহাসটাই পর্যালোচনা করুন। এ দেশে যে সব জাতি প্রথমে বাস করতো, তাদের গঠনমূলক যোগ্যতা ও কর্ম ক্ষমতা যখন শেষ হয়ে গেল, তখন আল্লাহ্ আর্য জাতিকে এ দেশ পরিচালনার সুযোগ দিলেন। সে সময় অন্যান্য জাতি গুলোর মধ্যে যোগ্যতম ছিল আর্যজাতি। তারা এখানে এসে এক উন্নত তামাদ্দুন ও সভ্যতা গড়ে তুললো। বহু জ্ঞান ও শিল্প আবিস্কার করল। ভূগর্ভের গোপন সম্পদ উদ্ধার করে তাকে ভাল কাজে ব্যবহার করল। ধ্বংসাত্মক কাজের তুলনায় গঠনমূলক কাজই তারা বেশী করেছিল। এসব যোগ্যতা যতদিন পর্যন্ত তাদের মধ্যে ছিল ততদিন ইতিহাসের সমস্ত উত্থান-পতন সত্ত্বেও তারাই ছিল এদেশের পরিচালক। অন্যান্য জাতি ক্ষমতা দখলের জন্য বার বার এগিয়ে এসেছে কিন্তু তাদেরকে হটিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ, আর্যদের মতো যোগ্য জাতি ক্ষমতাসীন থাকা কালে অন্যকোন পরিচালকের প্রয়োজন ছিল না। আর্যরা যখন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে বিপথে চলা শুরু করে, তখন তাদের উপর যেসব বৈদেশিক আক্রমন হয়, সেগুলোকে তাদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে সতর্ককারী দূত স্বরূপ বলা যায়। কিন্তু তারা সতর্ক না হয়ে ধ্বংসাত্মক কাজেই লিপ্ত থাকে। গঠনমূলক কাজের তুলনায় তারা ধ্বংসাত্মক কাজ করতে থাকে অনেক বেশী। তাদের নৈতিক অধঃপতন এমন চরমে পৌঁছে যে, বামমার্গ আন্দোলনে আজো তার চিহ্ন আপনারা সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারেন। মানবতাকে বিভক্ত করে তারা নিজেদেরই সমাজকে বর্ণ ও গোত্রে খণ্ডিত করল। সমাজ জীবনকে একটি সিঁড়ির মতো করে গঠন করল। এ সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপের লোকেরা তাদের উপরের ধাপের লোকদের বান্দা বা দাস এবং নীচু ধাপের লোকদের খোদা বনে বসল। তারা আল্লাহর লাখো লাখো বান্দার উপর নির্মম যুলুম নির্যাতন চালাতে লাগল। এ যুলুম আজো অচ্ছুত শ্রেণীর আকারে বিদ্যমান রয়েছে।
তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ করে দিল। তাদের পন্ডিত ও পুরোহিতরা সাপের মত জ্ঞান ভাণ্ডারের চারদিক বেষ্টন করে বসে রইল। তাদের উপরের তলার কর্তারা দেশের জনসাধারণের উপর নিজেদের বহু অন্যায় অধিকার চাপিয়ে দিল। এ অধিকার আদায় করা এবং আরাম কেদারায় বসে বসে অন্যের পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে বিলাসী জীবন যাপন করা ছাড়া তাদের আর কোন কাজ রইলো না। এহেন পরিস্থিতিতে আল্লাহ্ তাদের কাছ থেকে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মধ্য এশিয়ার কতিপয় জাতিকে এখানে পরিচালনার সুযোগ দিলেন। এ জাতিগুলো সে সময় ইসলামী আন্দালনের সংস্পর্শে এসে জীবন যুদ্ধের উন্নততর যোগ্যতা অর্জন করেছিল।
কয়েক'শ বছর তারা এদেশ পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিল। এ দেশেরও বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে তাদের সাথে মিশে গিয়েছিল। অবশ্যি তারাও অনেক কিছু ধ্বংস করেছে। কিন্তু যে পরিমাণ ধ্বংস করেছে, তার চেয়ে বেশী সৃষ্টি করেছে। কয়েক'শ বছর পর্যন্ত ভারতবর্ষে যত গঠনমূলক কাজ হয়েছে তা সবই তাদের দ্বারা অথবা তাদের প্রভাবে সম্পাদিত হয়েছে। তারা দেশে জ্ঞানের আলো বিতরন করেছে। চিন্তা ও ভাবধারা পরিশুদ্ধ করেছে। সমাজ, তামাদ্দুন ও সভ্যতার অনেক কিছু সংশোধন করেছে, দেশের উপায়-উপাদানকে সে যুগের উপযোগী করে কল্যাণের পথে ব্যবহার করেছে। সর্বোপরি তারা শান্তি ও সুবিচারের এমন সুষ্ঠু ব্যবস্থা কায়েম করেছিল যা ইসলামের সত্যিকার শান্তি ও সুবিচার থেকে অনেক নিন্মমানের হলেও ইতিপূর্বেকার এবং আশপাশের দেশগুলোর অবস্থার তুলনায় অনেক খানি ঊঁচুস্তরের ছিল। অতঃপর তারাও পূর্ববর্তীদের ন্যায় পথভ্রষ্ট হতে লাগল এবং তাদের মধ্যেও গঠনমূলক কাজের যোগ্যতা কমে যেতে লাগল এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের প্রতি ঝোঁক প্রবণতা বেড়ে চলল। তারাও উঁচু-নীচু, বংশ মর্যাদার শ্রেণী বিভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের সমাজ ও জাতিকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলল। এজন্য চারিত্রিক, রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে। তারাও ইনসাফের তুলনায় যুলুম, নির্যাতন অনেক বেশী করতে লাগল। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে গিয়ে তারা শুধু তাত্থেকে স্বার্থসিদ্ধি এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে অবৈধ স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টায় মেতে উঠল। উন্নতি ও সংস্কারমূলক কাজ ছেড়ে দিয়ে তারাও আল্লাহ্ প্রদত্ত শক্তি ও উপায় উপাদান নষ্ট করতে এবং সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে ব্যবহার করতে লাগল। দৈহিক আরাম ও ভোগ লালসায় তারা এতই মত্ত হয়ে গেল যে, তাদের শাসন কর্তাদেরকে যখন দিল্লীর লাল কেল্লা থেকে পলায়ন করতে হয়েছিল, তখন তাদের শাহজাদারা-যারা গতকাল পর্যন্ত সিংহাসনের দাবীদার ছিল-নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য পলায়ন করতেও পারেনি। কেননা মাটির উপর দিয়ে চলার অভ্যাস তারা পরিত্যাগ করেছিল। মুসলমানদের সাধারণ নৈতিক চরিত্রের চরম অধঃপতন হয়েছিল। একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় বড় হোমরা চোমরা দায়িত্বশীল লোকদের পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুরই পরোয়া ছিল না। ফলে ধর্ম, জাতি ও দেশকে অন্যের হাতে বিকিয়ে দেয়ার পথে তাদেরকে বাধা দেয়ার মতো আর কিছুই রইল না। তাদের মধ্যে জন্ম নিলো লাখো লাখো পেশাদার সিপাই। এদের নৈতিক চরিত্র ছিল পোষা কুকুরের মতো। যে কেউ খাবার দিয়ে এদেরকে পুষতে পারত এবং তারপর এদের দিয়ে ইচ্ছামত শিকার করাতে পারত। এদের মধ্যে এই অনুভূতি ছিলনা যে, এই ঘৃণ্য পেশার বদৌলতেই শত্রুরা তাদের সাহায্যে তাদেরই জয় করেছে -এর একটি জঘন্যতম দিক আছে। গালিবের মতো কবিও এ সম্পর্কে গর্ব করে বলেছনঃ "শত পুরুষ থেকে বাপ দাদার পেশা হলো সৈনিক বৃত্তি।" এতবড় একজন কবি একথা বলার সময় এতটুকুও ভাবতে পারেননি যে, পেশাধারী সৈনিকবৃত্তি গর্বের বিষয় নয়; লজ্জায়মরে যাবার জিনিস।
মুসলমানেরা যখন এহেন অবস্থায় পৌঁছল, তখন আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমতাচু্যত করার সিদ্ধান্ত করলেন এবং গোটা ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা আবার নতুন প্রার্থীদের হাতে যাওয়ার সুযোগ এলো। এ সময় দেশে মারাঠা, শিখ, ইংরেজ ও কতিপয় মুসলমান নেতা এই চারজন প্রার্থীকে দেখা যাচ্ছিল। জাতীয়তাবাদের নেশা ও স্বজাতির প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব থেকে মন ও মগযকে মুক্ত ও পবিত্র রেখে ন্যায়ভাবে তখনকার ইতিহাস ও পরবর্তী অবস্থা পর্যালোচনা করলে আপনার বিবেক একথা স্বীকার করবে যে, তখন গঠনমূলক কাজের যে যোগ্যতা ইংরেজদের ছিল তা অন্যকোন প্রার্থীর ছিল না এবং ইংরেজদের ভেতর যে পরিমাণ ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল তার চেয়ে ঢের বেশী ছিল মারাঠা, শিখ ও মুসলমান প্রার্থীর ভেতর। ইংরেজরা যা কিছু গঠনমূলক কাজ করেছে তা অন্যান্য জাতিরা করত না। তারা যা কিছু নষ্ট করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশী অন্যেরা নষ্ট করত। সাধারণভাবে দেখলে ইংরেজদের ভেতর বহু দিক দিয়ে অগণিত দোষ ও অন্যায় পাওয়া যাবে। কিন্তু তুলনা মূলকভাবে বিচার করলে তাদের সমকালীন প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে তাদের অন্যায় অত্যাচার অনেক কম এবং গুণ-গরিমা বেশী পাওয়া যাবে। এই জন্যই তো আল্লাহর আইন আরেকবার মানুষের মনগড়া নীতির মূলোচ্ছেদ করলো। মানুষ বিনা অধিকারে এই নীতি রচনা করেছিল যে- "প্রত্যেক দেশের অধিবাসীগণ সে দেশের মালিক, তারা তাদের ইচ্ছামত দেশকে গড়তেও পারে, ভাঙ্গতেও পারে।" আল্লাহর আইন ইতিহাসের এই চিরন্তন ফয়সালা থেকে প্রমাণ করেছে যে- না, দেশ এক মাত্র আল্লাহর, এর পরিচালনার ভার কাকে দেয়া হবে এ ফয়সালা তিনিই করবেন, এ ফয়সালা কোন বংশ, জাতি অথবা পিতা-প্রপিতার অধিকারের ভিত্তিতে হয় না। বরং কোন্ কোন্ পরিচালনায় সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে, সে দিকে নজর রেখেই এ ফয়সালা গৃহীত হয়।
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ. - سورة آل عمران26
"বলুন, হে আল্লাহ্! দেশের মালিক! তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে রাজ্য দিয়ে থাক এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নিয়ে থাক এবং যাকে চাও তাকে সম্মান এবং যাকে চাও লাঞ্ছনা দিয়ে থাক। তোমারই হাতে রয়েছে সব মঙ্গল। তুমি নিঃসন্দেহে সব কিছু করার ক্ষমতা রাখ।" [সূরা আলে ইমরানঃ ২৬]
এভাবেই হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে একটি জাতিকে আল্লাহ্ এ দেশে নিয়ে এলেন। এরা এ দেশে সংখ্যায় তিন চার লাখের বেশী কোন সময়ই ছিল না। কিন্তু এরা এখানকার উপায়-উপাদান ও মানুষ দিয়ে এ দেশের হিন্দু, মুসলমান, শিখ ইত্যাদি সমস্ত শক্তিকে পরাজিত করে দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করল। এ দেশের কোটি কোটি অধিবাসী এ মুষ্টিমেয় ইংরেজদের অধীন হয়ে রইল। একজন ইংরেজ একাই একটি জেলা শাসন করেছে। তাও এমন অবস্থায় যে, এ কাজে তার হাত শক্তিশালী করার মতো তার জাতির কোন লোক এখানে ছিল না। এসময় এ দেশের লোকেরা যা কিছু করেছে তা সবই চাকর হিসেবে করেছে- কার্যকারক হিসেবে নয়। ইংরেজদের শাসনামলে এ দেশে যেসব গঠনমূলক ও উন্নয়ণমূলক কাজ হয়েছে, তা তাদের দ্বারা এবং তাদের প্রভাবেই হয়েছে- এ কথা আমাদের সবাইকে স্বীকার করতে হবে। অস্বীকার করলে সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হবে। তারা যে অবস্থায় এদেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েছিল, তার তুলনায় আজকের অবস্থা দেখলে এ কথা স্বীকার করার জো নেই যে, তাদের অনিষ্টকারিতা সত্ত্বেও অনেক গঠনমূলক ও উন্নয়ণমূলক কাজ হয়েছে। এসব কাজ এদেশবাসীর দ্বারা সম্পন্ন হওয়ার কোন আশাই ছিল না। এ জন্যই তো আল্লাহ্ আঠার'শ শতাব্দীর মাঝখানে এ দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তা মোটেই ভুল ছিল না।
এখন দেখুন, ইংরেজরা যা কিছু গড়তে পারত তা গড়েছে আর বিশেষ কিছু তাদের দ্বারা গড়ে উঠতে পারে না। এখন তারা যা গড়তে পারে তা অন্যের দ্বারাও সম্ভব। ওদিকে তাদের ধ্বংসকারিতার বহর খুব বেড়ে গেছে। আর যতদিন তারা এ দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে, ততদিন গড়ার চেয়ে ভাঙ্গবেই বেশী। তাদের অন্যায় ও অপরাধের ফিরিস্তি এত দীর্ঘ হয়েছে যে, তা এক বৈঠকে বর্ণনা করা মুশকিল। আর সেগুলো বর্ণনা করার কোন প্রয়োজনও নেই। কারণ, সেসব সবার চোখের সামনেই রয়েছে। তাদেরকে এখন এ দেশের শাসন ক্ষমতা থেকে বেদখল করাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত। তারা নিজেরাই সোজাভাবে এ দেশ থেকে বিদায় নিতে প্রস্তুত হয়ে বেশ বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।
সোজাভাবে না গেলে বাঁকাভাবে তাড়িয়ে দেয়া হতো। কারণ, আল্লাহর চিরন্তন আইন এখন আর তাদের হাতে এ দেশের শাসন ক্ষমতা রাখার পক্ষপাতি নয়।
দুনিয়ার প্রকৃত মালিক কোন দেশে এক প্রকার পরিচালনা ব্যবস্থা খতম করে অন্য প্রকার ব্যবস্থা কায়েম করার ব্যবস্থা করলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, আমরা এখন তারই দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে আছি। এটা ইতিহাসের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাহ্যদৃষ্টিতে এ দেশে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে দেখা যাচ্ছে তাতে কেউ যেন এ প্রতারণায় না পড়েন যে, দেশের শাসনক্ষমতা দেশবাসীর হাতে দেয়ার এই যে সিদ্ধান্ত হচ্ছে তা একেবারে চূড়ান্ত ও চিরন্তন। বর্তমান পরিস্থিতির একটা সহজসাধ্য রূপ হয়তো আপনারা অনায়াসেই অনুধাবন করতে পারছেন যে, বিদেশ থেকে এসে যারা এ দেশ শাসন করছিল, এখন তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। কাজেই এখন স্বাভাবিকভাবেই দেশের ক্ষমতা দেশবাসীর হাতে আসাই উচিত। আসলে কিন্তু তা নয়। আল্লাহর সিদ্ধান্ত এরূপ হয় না। তিনি এই বিদেশীদেরকে পূর্বেও অকারণে আনেননি, আবার এখনো বিনা কারণে সরিয়ে দিচ্ছেন না। পূর্বে যেমন তিনি আপনাদের কাছ থেকে খামখেয়ালীভাবে শাসনক্ষমতা কেড়ে নেননি, তেমনি এখনো আপনাদেরকে খামখেয়ালীভাবে এ ক্ষমতা দেবেন না। আসল ব্যাপার এই যে, বর্তমানে ভারতবাসীরা ক্ষমতার প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছে; হিন্দু, মুসলমান, শিখ সবাই প্রার্থী। যেহেতু এরাই দেশে প্রথম থেকে বসবাস করে আসছে, কাজেই তাদেরকেই প্রথম ক্ষমতা লাভের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা স্থায়ী নিযুক্তি নয়, বরং তাদের পরীক্ষার জন্যই এ সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যদি তারা নিজেদের কার্যকলাপে প্রমাণ করে যে, ভাঙ্গার চেয়ে গড়ার যোগ্যতাই বেশী, তাহলে তাদেরকে এ দেশের শাসন ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করা হবে। আর যদি তারা গঠনমূলক কাজের চেয়ে ধ্বংসাত্মক কাজই বেশী করে, তবে তার পরিণাম খুব শিগগিরই ভোগ করবে। এ অবস্থায় তাদের কাছ থেকে এ দেশের শাসনক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অন্য কোন জাতিকে এ কাজের জন্য নির্বাচিত করা হবে। অতঃপর আর তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই করতে পারবে না। সমগ্র দুনিয়ার সম্মুখে নিজেদের অযোগ্যতার স্পষ্ট প্রমাণ দেয়ার পর তারা কোন মুখে অভিযোগ করবে ? নাছোড়বান্দা হয়ে অনুনয় বিনয় করলেও তা শুনবেই বা কে ?
এখন আপনারা একটু পর্যালোচনা করে দেখুন যে, এ দেশের হিন্দু-মুসলমান ও শিখ এ পরীক্ষায় আল্লাহর সামনে নিজেদের এমন কি যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, গুণ-গরিমা এবং কার্যকলাপ পেশ করেছেন যে, তার ফলে আল্লাহ্ তাঁর দেশের শাসন ক্ষমতা আবার তাদের হাতে সোপর্দ করবেন বলে তারা আশা করতে পারেন। হিন্দু, মুসলমান ও শিখদের অপরাধগুলো নৈতিকতার আদালতে পেশ করলে তারা সবাই দোষী সাব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি যদি এখন নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সুস্পষ্টভাবে সেগুলো বলে দেই, তাহলে আশা করি আপনারা খারাপ মনে করবেন না। নিজের জাতি ও স্বদেশী ভাইদের দোষ বর্ণনা করা আমারও ভাল লাগে না। আসলে আমার হৃদয় এতে কাঁদে। কারণ, আমি তাদের এ সমস্ত দোষ ও অপরাধের মারাত্নক পরিণাম যেন স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। তাদেরকে শিগ্গিরই এ পরিণামের সম্মুখীণ হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এসব দোষ ও অপরাধ তাদেরকে ধ্বংস করবে বলে আমার আশংকা হচ্ছে। আমি, আপনি কেউই এ মারাত্মক পরিণাম থেকে বাঁচতে পারবো না। এজন্য আমি অন্তরের বেদনা নিয়ে এগুলো বিবৃত করছি। এর ফলে যার কান আছে সে শুনে সংশোধনের কিছুটা চিন্তা করতে পারবে।
আমাদের দেশবাসীর সাধারণ নৈতিক চরিত্রের অবস্থা যে রকম হয়েছে তা আপনারা নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অনুযায়ী অনুমান করে দেখুন। আমাদের ভেতর শতকরা ক'জন সত্যিকার চরিত্রবান লোক আছে ? কারোর অধিকার হরণ করা, কোন অবৈধ স্বার্থসিদ্ধি, কোন 'লাভজনক' মিথ্যা বলা এবং কোন 'লাভজনক' বিশ্বাস-ঘাতকতা করা নৈতিক দৃষ্টিতে খারাপ -শুধু এই কারণে আমাদের ক'জন এসব কাজ করতে ইতস্তত করে থাকে? যেখানে আইনের বাঁধন নেই অথবা যেখানে আইনের আওতা থেকে বাঁচবার আশা ও পথ আছে, সেখানে শতকরা ক'জন শুধু নিজের নৈতিক অনুভূতির বলে অন্যায় ও অপরাধ থেকে বিরত থাকে? যেখানে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের আশা না থাকে, সেখানে ক'জন অন্যের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে। এরূপ ক্ষেত্রে ক'জন অপরের দুঃখে-দৈন্যে মনে ব্যাথা পায় এবং স্বার্থ ত্যাগ করে? নিস্বার্থভাবে ক'জন অপরের হক আদায় করে? ক' জন ব্যবসায়ী ধোঁকা-ফাঁকি, মিথ্যা, মুনাফাখোরী, অন্যায়ভাবে উপার্জন করা থেকে বিরত থাকে? ক'জন শিল্পপতি নিজের স্বার্থের সঙ্গে ক্রেতাদের স্বার্থ এবং নিজের জাতি ও দেশের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রাখে? খাদ্যশস্য মজুদ রেখে অত্যাধিক চড়া দরে বিক্রি করতে গিয়ে ক'জন জমিদার একটু ভেবে দেখে যে, তারা এ মুনাফাকারীর দ্বারা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষকে ভূখা রেখে অসহ্য যন্ত্রনা দিচ্ছে? ক'জন ধনী ব্যক্তি ধন উপার্জনে অন্যায়, অত্যাচার, অধিকার হরণ ও বিশ্বাস ঘাতকতা থেকে মুক্ত রয়েছে? আমাদের দেশের শ্রমজীবি দের মধ্যে ক'জন সঠিকভাবে কর্তব্য পালন করে তাদের বেতন ও পারিশ্রমিক গ্রহণ করে? ক'জন সরকারী কর্মচারী ঘুষ, আমানত খেয়ানত, অত্যাচার, উৎপীড়ন, কর্তব্যে অবহেলা, হারাম খাওয়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকে? উকিল, চিকিৎসক, সাংবাদিক, গ্রন্থকার, প্রকাশক, জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক ও নেতৃবৃন্দের ক'জন নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য অসৎ ও ঘৃন্য পন্থা অবলম্বন করে না? এদের ক'জন মানুষের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আর্থিক ক্ষতি সাধনে কিছু মাত্র লজ্জা বোধ করে? বড় জোর দেশের শতকরা মাত্র পাঁচজন এসব নৈতিক রোগ থেকে মুক্ত রয়েছে, আমার মনে হয় একথা মোটেই অতু্যক্তি নয়। বাকী পঁচানব্বই জনই এই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত। এ ব্যাপারে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খৃষ্টান প্রভৃতির ভেতর কোন পার্থক্য নেই। সবাই সমানভাবে রোগাক্রান্ত। সবারই নৈতিক অবস্থার চরম ও ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। কোন জাতির অবস্থাই অন্য জাতির চেয়ে ভাল নয়।
অধিকাংশ লোক এরূপ নৈতিক অধঃপতনের কবলে পড়ায় সমষ্টিগত ভাবে এই নৈতিক রোগের ব্যাপক প্রসার হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। গত মহাযুদ্ধের কারণে যখন রেল গাড়ীতে যাত্রীদের ভীড় হতে লাগলো তখন এই সম্ভাব্য তুফানের প্রথম লক্ষণ দেখা দিল। সেখানে একই জাতির ও একই দেশের লোকেরা পরস্পরের সঙ্গে যে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতামূলক ব্যবহার করেছে, তা থেকেই টের পাওয়া গিয়েছিল যে, কেবল দ্রুতগতিতে আমাদের সাধারণ নৈতিক চরিত্রের অবনতি ঘটেছে। এরপর প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের অভাব ও উচ্চমূল্যের সময় মাল মজুদ রাখা এবং চোরাবাজারী ব্যাপক ভাবে শুরু হয়। অতঃপর দেখা দিল বাংলাদেশের সেই ভয়াবহ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। এই দুরাবস্থার সময় দেশের এক সমপ্রদায় নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য নিজেদের দেশের লাখো লাখো মানুষকে ভূখা রেখে তিলে তিলে মৃতু্যর দিকে এগিয়ে দিয়েছে। এসব ছিল প্রাথমিক লক্ষণ, এরপর নোংরামি, বর্বরতা, নীচতা, পশুসুলভ আচরণ ইত্যাদির অগি্নকাণ্ড হঠাৎ ফেটে পড়লো। এগুলো এখানকার গভীরে বহুদিন হতে উত্তপ্ত হচ্ছিল। বর্তমানে একটি সামপ্রদায়িক দাঙ্গারূপে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সবকিছু জ্বালিয়ে ছাই করে দিচ্ছে। কলকাতার গোলযোগের পর থেকে হিন্দু, মুসলমান ও শিখদের জাতীয় বিরোধের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনটি জাতিই তাদের জঘন্য চরিত্রের প্রদর্শনী করে বেড়াচ্ছে।
যে সমস্ত কাজ কোন মানুষ করতে পারে বলে ধারণাও করা যেত না, তা আজ আমাদের দেশবাসীরা প্রকাশ্যে করে যাচ্ছে। বড় বড় অঞ্চলের প্রায় সমস্ত লোক গুন্ডায় পরিণত হয়েছে। গুন্ডারা যে কাজ করার ধারণাও কোন দিন করেনি তাও এখন তারা করছে। দুগ্ধ-পোষ্য শিশুদের মায়ের বুকের উপর রেখে জবাই করা হয়েছে, জীবন্ত মানুষদেরকে আগুনে জ্বালানো হয়েছে। ভদ্র মহিলাদের হাজার হাজার লোকের সামনে উলঙ্গ করে তাদের উপর প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। পিতা, ভাই ও স্বামীর সামনে তাদের মেয়ে, বোন ও স্ত্রীর শ্লীলতা হানি করা হয়েছে। মসজিদ, মন্দির ও ধর্মীয় গ্রন্থরাজির উপর ক্রোধ প্রকাশ করতে গিয়ে অত্যন্ত পৈশাচিক উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। রুগ্ন, আহত ও বৃদ্ধাদেরকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। পথিক যাত্রীদেরকে চলন্ত গাড়ী থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। জীবন্ত মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কর্তন করা হয়েছে। নিরীহ ও অক্ষম লোকদেরকে জন্তু-জানোয়ারের মতো শিকার করা হয়েছে। প্রতিবেশী ও প্রতিবেশীর গৃহ লুট-তরায করেছে। বন্ধুর প্রতি বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আশ্রয় দাতা আশ্রয় দিয়ে নিরাশ্রয় করেছে। শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষকগণ (পুলিশ, সৈন্য ও ম্যাজিষ্ট্রেটগণ) প্রকাশ্যে দাঙ্গায় অংশ গ্রহণ করেছে এমনকি তারা নিজেরাই দাঙ্গা করেছে এবং নিজেদের সাহায্য সহানুভূতি ও তত্ত্বাবধানে দাঙ্গা বাধিয়েছে। মোটকথা, অত্যাচার, অনাচার, নিষ্ঠুর ও নির্দয় ব্যবহার, বর্বরতা ও জঘন্য কার্যকলাপ ইত্যাদির কোন কিছু আর বাকী নেই, যা এ কয়েক মাসের ভেতর আমাদের দেশের লোকেরা সমষ্টিগতভাবে করেনি। তবুও মনের জ্বালা মেটেনি। আলামত যা দেখা যাচ্ছে, মনে হয় এর চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ ও বিরাট আকারে দাংগা এখন দেখা দেবে।
আপনারা কি মনে করেন, এসব কিছুই একটা আকস্মিক উত্তেজনার ফল মাত্র। এরূপ ধারনা করে থাকলে আপনারা বিরাট ভুলের মধ্যে আছেন বলতে হবে। এই মাত্র আমি আপনাদের বলেছি যে, এ দেশের শতকরা পঁচানব্বই জন নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। দেশের জন সমষ্টির এত বিরাট অংশ যদি অসৎ চরিত্রের হয়ে পড়ে তা হলে জাতির সমষ্টিগত স্বভাব চরিত্র কেমন করে ঠিক থাকতে পারে? এই জন্যই তো হিন্দু-মুসলমান ও শিখ জাতির কাছে সত্যবাদিতা, সুবিচার ও সততার কোন দামই এখন নেই। সত্যপন্থী, সৎ এবং ভদ্রস্বভাব বিশিষ্ট লোকেরা তাদের ভিতর কোনঠাসা ও দুর্বল হয়ে রয়েছে। মন্দ কাজে বাধা দান এবং ভাল কাজ করার জন্য উপদেশ দেয়া তাদের সমাজে অসহনীয় অপরাধে পরিণত হয়েছে, সত্য ও ন্যায় কথা শুনতে তারা প্রস্তুত নয়।
তাদের মধ্যে একটি জাতিই এমন লোকদেরকে পছন্দ করে যারা তার সীমাহীন লোভ লালসা ও স্বার্থের পক্ষে ওকালতি করে এবং অন্যের বিরুদ্ধে তাকে উত্তেজিত করে তার ন্যায় ও অন্যায় সবরকম স্বার্থোদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করতে প্রস্তুত হয়। এজন্যই এরা নিজেদের ভিতর থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে দুষ্ট প্রকৃতির লোকদেরকে নিজেদের নেতা নির্বাচন করেছে। তারা নিজেদের জঘন্যতম অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করে তাদেরকে নিজেদের নেতৃত্ব পদে বরণ করে নিয়েছে। তাদের সমাজে সবচেয়ে দুশ্চরিত্র, দূর্নীতিবাজ, বিবেকহীন লোকেরা তাদের মুখপাত্র সেজে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অত্যাধিক বরণীয় হয়েছে। অতঃপর এসব লোকেরা নিজ নিজ পথভ্রষ্ট জাতিকে নিয়ে ধ্বংসের পথে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। তারা জাতির পরস্পর বিরোধী আশা-আকাংখাকে কোন ইনসাফের কেন্দ্রবিন্দুতে একত্রিত না করে তাকে এতখানি বাড়িয়ে দিয়েছে যে, তা অবশেষে সংঘর্ষের সীমান্তে পৌঁছেছে। তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘর্ষে ক্রোধ, ঘৃণা, শত্রুতার বিষ মিশিয়ে একে নিত্য অগ্রবর্তী করেছে। বহু বছর ধরে নিজেদের প্রভাবাধীন জাতিগুলোকে উত্তেজনামূলক বক্তৃতা ও রচনার ইনজেকশন দিয়ে এতখানি উত্তেজিত করে তুলেছে যে, এখন উত্তেৎনাবশতঃ কুকুর ও হিংস্র পশুর মত লড়াই করবার জন্য খড়গ উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজের মনকে পৈশাচিক আবেগ ও উচ্ছাসে দূর্গন্ধময় এবং অন্ধ শত্রুতার চুল্লীবানিয়ে ফেলেছে। আপনাদের সামনে এখন যে তুফান প্রবাহিত হচ্ছে তা মোটেই সাময়িক ও আকস্মিক নয়। বহুদিন থেকে বিকৃতির যেসব বেশুমার কার্যকারণ আমাদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে এ হলো তারই স্বাভাবিক পরণতি। এটা একবার দেখা দিয়েই ক্ষান্ত হবে না; বরং যতদিন পর্যন্ত এসব কার্যকারণ সক্রিয় থাকবে, ততদিন এ বিকৃতি ক্রমশ বাড়তে থাকবে। এটা একটা শস্যপূর্ণ ক্ষেতের মত। বহু বছরের বীজ বপন ও জল সেচের পর এ ফসল খাবার উপযুক্ত হয়েছে। এখন আপনাকে এবং আপনার বংশধরদেরকে কতদিন পর্যন্ত এ ফসল কাটতে হবে তা বলা যায় না।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন