প্রজাপতির নদী পারাপার
তবুও কমলার অনেক কথা বলার ছিলো। যে বয়সে কথা কমে গিয়ে ভাবুক হবার পাঁয়তারা খোঁজে মেয়েরা সেই বয়েস তার, অথচ কথা কিন্তু সে বেশীই বলতো। খুব আবোল-তাবোল না, বরং খানিকটা গুছিয়ে, কিন্তু একটু দ্রুত, শব্দের শেষ দিকের উচ্চারণ কেমন মিইয়ে মিইয়ে যেতো ওর মুখের ভেতর। সবাই একরকম উপভোগ করে সেগুলো, কিছু কিছু শব্দ নকল করে হাসাহাসিও হতো খুব। কমলাও একচোট হেসে টেসে ওর চাঁদের মতো, অন্তত পাড়ার মহিলারা তাই বলতো, যেখানে ঠোঁটের বাঁদিকে ছোট তিল আর ডান গালে টোল রয়েছে সেই গোল মুখ লাল করে ফেলতো আর কখনো সখনো বলতো , - আচ্ছা, আমি কি এমন হাসির কথা বলেছি?
আসলে কথাটা যে হাসির নয়, বলাটা, কমলার বাবা রেলের ষ্টেশনমাষ্টার বলেই একটা আপাত ভদ্রতা, কেউ সাহস বা বিনয় করে বলতো না যে, ওর কথা বলার ধরণে হাসাহাসি হচ্ছে। শুধু ওর মা চশমা আর সিঁদুর পরা মাস্টারনী নামধারী দিব্বি সুন্দরী মহিলাটি সারাক্ষণ ধমকাতো। উচ্চারণ নিয়ে, হাঁটাচলা নিয়ে, বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে, খোলা চুল নিয়ে। অথচ কমলা, টান টান সবুজ সাটিনের কামিজের ওপর লাল ওড়নাটাকে শুধু গলার কাছটাতে কোন রকম লটকে, আসলে ওড়না জিনিষটাকেই একটা বাহুল্য ভেবে খোলা চুলে রেললাইন ধরে হেঁটে যেতে বেশী পছন্দ করতো, ফুরফুরে ভাব আসতো তার মনে।
একদিন বৈশাখের বিকাল বেলা, বিরক্তির চুড়ান্ত রকম হাওয়ার মধ্যে কমলারা দুইবোন যখন হেঁটে আসছিলো, শুধু কমলার ওড়নাটাই তখন ধাঁ করে বুকের আলিঙ্গন ছেড়ে উড়ে গেল। কমলা দু হাত তুলে ঢেউ-খেলানো ওড়নার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মোস্তফাদের মাছের আড়তে। ততক্ষণে মোস্তফা মাছ মাপ-জোকের তদারকি ছেড়ে লাল জর্জেট দুহাতে আটকে ফেলেছে। দুহাত দিয়ে ধরতে হয়েছে বলে ওর পরনের চেক লুঙ্গি পায়ের গোড়ালি ছেড়ে হাঁটু ছুঁয়ে ফেলেছে। ফর্সা লোমশ পায়ের হাঁটু অবধি, যা কমলারা প্রায়ই দেখে, আসতে, যেতে, যেহেতু রেলষ্টেশনের লাগোয়া মোস্তফাদের মাছের আড়ত। ওদের বংশানুক্রম চালান মাছের ব্যবসা, মাল ট্রেনে চালান আসে। কখনো জলে না নামলেও লোকে নাম দিয়েছে – মাছুয়া। মোস্তফা ওর বাবার প্রক্সি দিয়ে, বাঁ হাতে হাঁটুর ওপর লুঙ্গি উঁচিয়ে কর্মচারীদের নির্দেশ-টির্দেশ দেয়। যখনতখন কর কর শব্দ তুলে ফর্সা মুখ সান গ্লাসে ঢেকে হোন্ডা চালায়। তখনো অবশ্য ওর পা হাঁটু পর্যন্ত অনাবৃত থাকে। কমলারা দুই বোন প্রায়ই যুতসই নাম খোঁজে মোস্তফাকে দেবার জন্য। যেহেতু ষ্টেশনমাষ্টারের সংগে ব্যবসাগত সম্পর্কটিকে মোস্তফারা বেশ দক্ষতার সাথে পারিবারিক করে ফেলেছে, সে বিবাহযোগ্য, সুতরাং কমলারা মায়েদের সংগে দু একবার তার জন্য পাত্রী দেখতেও গেছে।
তো লাল জর্জেট যখন মাছের ফুলকোর মত মোস্তফার হাতে মৃতপ্রায়, কমলার মনে হয়, ওড়না বস্তুটি যদি পরতেই হয়, তা হলে এভাবে কালবৈশাখী বাতাসের কাছে হাতছাড়া করা উচিত না। কমলার বোনের সেই সমস্যা নাই, আঁচলতো ধরাতেই অভ্যস্ত।
কমলার আরো মনে হয়, তার কথাবার্তা নিয়ে মোস্তফা কোনদিন হাসিতে যোগ দেয়নি। ব্যবসায়ীর অতিরিক্ত ব্যস্ততা কিংবা এসব রোজকার হাসিঠাট্টার মত তুচ্ছ অথচ প্রয়োজনীয় বিষয়ে এ যুবকটির মনযোগের যোগ্যতা নাও থাকতে পারে, এ ভাবনা তার মাথায় আসে না।
অবশ্য আরো একদিন, পাড়ার সবার কাছে কমলা কৃতজ্ঞ, সবাই ওর গল্পটি শুনে বিষন্ন হয়ে গিয়েছিল। অন্তত কমলা মনে প্রাণে চাইছিলো তাই হোক, কেননা, সে নিজেই যারপরনাই বিষণ্ণ ছিল। সে তার সদ্য দেখা ঘটনাটি বেশ বিস্তারিত বলেছিল। একটা বিচিত্র রং প্রজাপতি, যে কিনা, কমলা বুঝতেই পারেনা, কোন আত্মবিশ্বাসে ভর করে বর্ষার প্রায় আধমাইলটাক চওড়া নদীর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। কোন একটা উপন্যাসে পড়া বর্ণনার সঙ্গে প্রায় মিলে যায় বলে ওর আরো বেশী অবাক হওয়ার যোগাড়। নৌকায় থাকা অন্যকয়েকজনের অলক্ষ্যে কমলার নিজের বুকের দুরু দুরু আর প্রজাপতিটির হৃদস্পন্দন এক হয়ে গিয়েছিল। কমলা তার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির পাখার ক্লান্তি, ব্যথা আর পথ না ফুরানোর অসহায়তা অনুভব করেছিল।
শেষমেষ নৌকা বাঁক নিলে প্রজাপতি তো আর তার সড়ক বদলালো না, কমলার মন পড়ে থাকলো ওর নীল, সবুজ আর সোনালীর ঠিকরানোর মধ্যে। বেশ তীব্র রোদ, প্রজাপতিরা তৃষ্ণার্ত হয় কিনা, এ প্রশ্ন কমলাকে আত্মমগ্ন করেছিল সঙ্গত কারণেই। মোস্তফা কিংবা তার অন্য মনযোগী শ্রোতারা কেউ উত্তর দিতে পারেনি। ওর বাবা অবশ্য অনিশ্চিতভাবে বলেছিল-“ওরা তো ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়, ওতেই পিপাসা মেটার কথা, কতটুকুই বা তৃষ্ণা হবে একটা প্রজাপতির!”
কিন্ত কমলার প্রায়ই মনে পড়ে, তীব্র গনগনে রোদের মধ্যে ছোট্ট প্রজাপতির নদী পারাপারের দৃশ্য আর তখন সে নিজেই প্রচন্ড তৃষ্ণা অনুভব করে।
মৃত মাছের চোখ তবুও কমলার অনেক কথা বলার ছিলো। যে বয়সে কথা কমে গিয়ে ভাবুক হবার পাঁয়তারা খোঁজে মেয়েরা সেই বয়েস তার, অথচ কথা কিন্তু সে বেশীই বলতো। খুব আবোল-তাবোল না, বরং খানিকটা গুছিয়ে, কিন্তু একটু দ্রুত, শব্দের শেষ দিকের উচ্চারণ কেমন মিইয়ে মিইয়ে যেতো ওর মুখের ভেতর। সবাই একরকম উপভোগ করে সেগুলো, কিছু কিছু শব্দ নকল করে হাসাহাসিও হতো খুব। কমলাও একচোট হেসে টেসে ওর চাঁদের মতো, অন্তত পাড়ার মহিলারা তাই বলতো, যেখানে ঠোঁটের বাঁদিকে ছোট তিল আর ডান গালে টোল রয়েছে সেই গোল মুখ লাল করে ফেলতো আর কখনো সখনো বলতো , - আচ্ছা, আমি কি এমন হাসির কথা বলেছি?
আসলে কথাটা যে হাসির নয়, বলাটা, কমলার বাবা রেলের ষ্টেশনমাষ্টার বলেই একটা আপাত ভদ্রতা, কেউ সাহস বা বিনয় করে বলতো না যে, ওর কথা বলার ধরণে হাসাহাসি হচ্ছে। শুধু ওর মা চশমা আর সিঁদুর পরা মাস্টারনী নামধারী দিব্বি সুন্দরী মহিলাটি সারাক্ষণ ধমকাতো। উচ্চারণ নিয়ে, হাঁটাচলা নিয়ে, বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে, খোলা চুল নিয়ে। অথচ কমলা, টান টান সবুজ সাটিনের কামিজের ওপর লাল ওড়নাটাকে শুধু গলার কাছটাতে কোন রকম লটকে, আসলে ওড়না জিনিষটাকেই একটা বাহুল্য ভেবে খোলা চুলে রেললাইন ধরে হেঁটে যেতে বেশী পছন্দ করতো, ফুরফুরে ভাব আসতো তার মনে।
একদিন বৈশাখের বিকাল বেলা, বিরক্তির চুড়ান্ত রকম হাওয়ার মধ্যে কমলারা দুইবোন যখন হেঁটে আসছিলো, শুধু কমলার ওড়নাটাই তখন ধাঁ করে বুকের আলিঙ্গন ছেড়ে উড়ে গেল। কমলা দু হাত তুলে ঢেউ-খেলানো ওড়নার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মোস্তফাদের মাছের আড়তে। ততক্ষণে মোস্তফা মাছ মাপ-জোকের তদারকি ছেড়ে লাল জর্জেট দুহাতে আটকে ফেলেছে। দুহাত দিয়ে ধরতে হয়েছে বলে ওর পরনের চেক লুঙ্গি পায়ের গোড়ালি ছেড়ে হাঁটু ছুঁয়ে ফেলেছে। ফর্সা লোমশ পায়ের হাঁটু অবধি, যা কমলারা প্রায়ই দেখে, আসতে, যেতে, যেহেতু রেলষ্টেশনের লাগোয়া মোস্তফাদের মাছের আড়ত। ওদের বংশানুক্রম চালান মাছের ব্যবসা, মাল ট্রেনে চালান আসে। কখনো জলে না নামলেও লোকে নাম দিয়েছে – মাছুয়া। মোস্তফা ওর বাবার প্রক্সি দিয়ে, বাঁ হাতে হাঁটুর ওপর লুঙ্গি উঁচিয়ে কর্মচারীদের নির্দেশ-টির্দেশ দেয়। যখনতখন কর কর শব্দ তুলে ফর্সা মুখ সান গ্লাসে ঢেকে হোন্ডা চালায়। তখনো অবশ্য ওর পা হাঁটু পর্যন্ত অনাবৃত থাকে। কমলারা দুই বোন প্রায়ই যুতসই নাম খোঁজে মোস্তফাকে দেবার জন্য। যেহেতু ষ্টেশনমাষ্টারের সংগে ব্যবসাগত সম্পর্কটিকে মোস্তফারা বেশ দক্ষতার সাথে পারিবারিক করে ফেলেছে, সে বিবাহযোগ্য, সুতরাং কমলারা মায়েদের সংগে দু একবার তার জন্য পাত্রী দেখতেও গেছে।
তো লাল জর্জেট যখন মাছের ফুলকোর মত মোস্তফার হাতে মৃতপ্রায়, কমলার মনে হয়, ওড়না বস্তুটি যদি পরতেই হয়, তা হলে এভাবে কালবৈশাখী বাতাসের কাছে হাতছাড়া করা উচিত না। কমলার বোনের সেই সমস্যা নাই, আঁচলতো ধরাতেই অভ্যস্ত।
কমলার আরো মনে হয়, তার কথাবার্তা নিয়ে মোস্তফা কোনদিন হাসিতে যোগ দেয়নি। ব্যবসায়ীর অতিরিক্ত ব্যস্ততা কিংবা এসব রোজকার হাসিঠাট্টার মত তুচ্ছ অথচ প্রয়োজনীয় বিষয়ে এ যুবকটির মনযোগের যোগ্যতা নাও থাকতে পারে, এ ভাবনা তার মাথায় আসে না।
অবশ্য আরো একদিন, পাড়ার সবার কাছে কমলা কৃতজ্ঞ, সবাই ওর গল্পটি শুনে বিষন্ন হয়ে গিয়েছিল। অন্তত কমলা মনে প্রাণে চাইছিলো তাই হোক, কেননা, সে নিজেই যারপরনাই বিষণ্ণ ছিল। সে তার সদ্য দেখা ঘটনাটি বেশ বিস্তারিত বলেছিল। একটা বিচিত্র রং প্রজাপতি, যে কিনা, কমলা বুঝতেই পারেনা, কোন আত্মবিশ্বাসে ভর করে বর্ষার প্রায় আধমাইলটাক চওড়া নদীর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। কোন একটা উপন্যাসে পড়া বর্ণনার সঙ্গে প্রায় মিলে যায় বলে ওর আরো বেশী অবাক হওয়ার যোগাড়। নৌকায় থাকা অন্যকয়েকজনের অলক্ষ্যে কমলার নিজের বুকের দুরু দুরু আর প্রজাপতিটির হৃদস্পন্দন এক হয়ে গিয়েছিল। কমলা তার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির পাখার ক্লান্তি, ব্যথা আর পথ না ফুরানোর অসহায়তা অনুভব করেছিল।
শেষমেষ নৌকা বাঁক নিলে প্রজাপতি তো আর তার সড়ক বদলালো না, কমলার মন পড়ে থাকলো ওর নীল, সবুজ আর সোনালীর ঠিকরানোর মধ্যে। বেশ তীব্র রোদ, প্রজাপতিরা তৃষ্ণার্ত হয় কিনা, এ প্রশ্ন কমলাকে আত্মমগ্ন করেছিল সঙ্গত কারণেই। মোস্তফা কিংবা তার অন্য মনযোগী শ্রোতারা কেউ উত্তর দিতে পারেনি। ওর বাবা অবশ্য অনিশ্চিতভাবে বলেছিল-“ওরা তো ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়, ওতেই পিপাসা মেটার কথা, কতটুকুই বা তৃষ্ণা হবে একটা প্রজাপতির!”
কিন্ত কমলার প্রায়ই মনে পড়ে, তীব্র গনগনে রোদের মধ্যে ছোট্ট প্রজাপতির নদী পারাপারের দৃশ্য আর তখন সে নিজেই প্রচন্ড তৃষ্ণা অনুভব করে।
কেউই নিশ্চিত হতে পারেনা, কমলার কি হতে পারে, যাতে করে তার জ্বলজ্বলে চোখের তারা যেখানে যখন তখন পনেরো বর্ষীয় কৌতুহল আর অভিমান খেলা করতো, তা কিরকম মাছের মত হয়ে গেলো। কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে আঙ্গুল তুলে মাছের আড়ত দেখায়, কিন্ত ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে সরেও আসে যখন মোস্তফাকে আগের ভঙ্গিতে কমলাদের ফুলের বেড়া দেয়া বাগানের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কমলার মায়ের সঙ্গে আগের মতই কিংবা আরো একটু বেশী, বিনয়ী বাক্যালাপরত দেখে।
একজন আরেকজনকে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কমলার তাবত কর্মকান্ডে মোস্তফার প্রাণপণ খাটুনি, এমন কি তারও আগে, বিচিত্র অসুখে কাতর মেয়েটিকে জেলাশহরে ভালো ডাক্তারের কাছে পৌঁছানোর জন্য গাড়ী জোগাড় ইত্যাদি, এমন কি তার আগেও – কমলার সবকটি ভাইবোনের সঙ্গে প্রাণোচ্ছল আন্তরিকতার সম্পর্ক, সবাই মিলে মোস্তফার নেতৃত্বে, তারই বেবীট্যাক্সীগুলোর মধ্যে থেকে একটি দখল করে সিনেমা দেখতে যাওয়া, জোস্নারাত্রে রেললাইনের ওপর দিয়ে না পড়ে গিয়ে হাঁটার কম্পিটিশান ইত্যকার কারণে, নিরুদ্বিগ্ন ষ্টেশনমাষ্টারের বাড়িতে যে হাসি গল্পের জমজমাটি, সে ও তো মোস্তফারই কারণে। অবশ্য ছেলেটি কথা বলতো কম, শুনতো বেশী, কমলারা যেন ওকে মুগ্ধ করতে, ওর সবচে রঙ্গিন ঝালর লাগানো বেবীট্যাক্সীতে চড়ে সিনেমায় যাবার কৃতজ্ঞতায়, বেশী বেশী চঞ্চল হয়ে উঠতো। আর তা ছাড়া- মাছ, ট্রেন, রেলের হিসাব নিকাশ তো ছিলই , তাই কি পরিবারের সবাইকে মোস্তফাকেন্দ্রিক করে তুলেছিল?
মামাতো বোনের বিয়ে, কমলার বোনটির জ্বর। মা না হয় নাই গেল, প্রতিবাদমূখর কমলাদের সমাধান মোস্তফা। ট্রেনের যাত্রা, ব্যবসার আনুসঙ্গিক সমস্যা রেখেও সে যখন রাজী, কমলারা তখন সত্যিই কৃতজ্ঞ।
ফেরার পথে সমস্যা। ট্রেন বন্ধ, আর তা জানা গেল মামার বাড়ি থেকে বাসের পথটুকু পার হবার পরে। সন্ধ্যার ট্রেন ভোরে ছাড়বে। মোস্তফার তড়িৎ বুদ্ধি আর কমলাদের পরিচয় কাজে লাগালে ষ্টেশনমাষ্টার রেলের বোর্ডিং- এ থাকার ব্যবস্থা করলেন। ধবধবে শাদা চাদর পাতা দুটো বিছানা, কমলার জীবনে প্রথম বাড়ির বাইরে রাত্রিবাস। ভাইবোনেরা ঘুমিয়ে পড়লেও, জানালাতে গড়িয়ে নামা চাঁদের আলোর দিকে কমলা নির্ঘুম তাকিয়েছিল। হোটেলে রাত্রিবাসে নিষিদ্ধ আনন্দ আছে।
কমলার যে আরো কথা বলার ছিল, তা তার বসে থাকার ভংগিতে বোঝা যেত, কিন্তু মনে হতো খনার জন্মের সংগে নিজেকে একাত্ম করে কষ্ট পাচ্ছিল সে। যার পর নাই কষ্ট, জ্বলজ্বলে কালো চোখের তারায় ধীরে ধীরে বাসা বাধছিলো ফ্যাকাশে দুঃখ যা ওর রংগিন জামাকাপড়গুলোকে ম্লান করে দিচ্ছিল। সারাদিনই প্রায় হাত কোলে করে ওদের বাগানে বা জানালায়, চোখ কখনো মাছের আড়তে, কখনো বা রেল লাইনের শেষ বিন্দুতে, কেন যেন আকাশের দিকে চাইতো না কমলা। কয়েক দিন রেলষ্টেশনের পুরানো দূরবীণ থাকতো কোলে, চোখে উঠতো না।ওর ব্যথা বেদনা কি, উতস কোথায় তা জানার উপায় ছিল কম , কেননা কমলা তখন কথা ভুলেছে। চাঁদপনা মুখ চৌকো, খোলা চুলে মা ব্যান্ড আটকে দেয় সকালে, কখনো ছিটে ফোটা ক্রিম, পাউডার।
এ দৃশ্য যখন স্বাভাবিক দৃশ্যে পরিণত হওয়া শুরু হলো তার দু এক দিনের মধ্যেই কমলাকে চিতায় শোয়ানো হলো। আবারো শোকের গম্ভীর হাওয়া। সকলের সমীহভরা চাহনি কমলাদের ফুলেল গেটঅলা বাড়ির দিকে। আহা, সবার যেন শোক বইবার শক্তি হয়। এমন চাঁদের মত সুন্দরী বাচ্চা মেয়েটি। ওর কথার শেষের অক্ষরগুলো বাতাসে নুয়ে নুয়ে হাঁটে, কেউ তা নিয়ে হাসাহাসি করে না।
অতলের মীন
শ্রাবণের বৃষ্টি যখন নিভু নিভু, মোস্তফার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক, সে সময় কেউ একজন বাতাসে কথাটা ছড়ায়- কমলা আসলে খুন হয়েছে। একদিন হঠাত করে মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকতেই একদিন নিহত হয়েছিল সে, তারপর মৃতপ্রায় আরো কিছুদিন বেঁচেছিল। লোকটি ওর বাবামায়ের অধৈর্য্য সংলাপ শুনেছে, এই দেশে এই খুনের বিচার সম্ভব না ইত্যাদি, এসবই শুনেছে। কমলার আত্মঘাতী হবার কাহিনী পিপীলিকার ছয় পায়ে পাড়াময় হেঁটে বেড়ায়, তার মৃত্যু রহস্যোপোন্যাস হয়ে যায়, আর তা দিয়ে ওর প্রজাপতির গল্পটা, যেটি কমলার প্রিয় গল্প ছিল, পুড়ে যেতে থাকে।
এখন সবাই সাহস করেই আঙ্গুল উঁচিয়ে মোস্তফার মাছের আড়ত দেখায়, কেননা কমলার সেদিনের রাত্রিবাসের গল্প এখন সবার জানা। কমলা যখন নির্জীব বসে থাকতো, ওর ঘনিষ্ঠ দু চারজন- কখনো কখনো ওর ভেতর থেকে ছায়ার মত অন্য এক কমলার উঠে আসা দেখেছে, এই কমলার
সংগে আগের কমলার মিল আছে, পাশাপাশি সুক্ষ বদল ও চোখে পড়ে। বুকে ওড়না নেই, জুতো স্যান্ডেলের বালাই নেই, ফর্সা পা ধুলোয় ঢেকে আছে। সবচে বড় পরিবর্তন – যা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে যে এই কমলার মুখ থেকে কমনীয়তা সরে গিয়ে কী এক কঠিন সন্ধিগ্ধতা ঝুলছে, সব কিছু আগের মত চোখ বড় করে বিশ্বাস করে ফেলছে না, বরং রাগী বেড়ালের মত উঠানের মাটি খুটতে খুটতে চোখ সরু করে সন্দেহ প্রকাশ করছে।
সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে, অতি সংগত কারণে, কেননা এই কমলা নিজের অতি গোপন কথাগুলি ও অব লীলায়, দৃঢ়তার সাথে বলে ফেলছে। আগের মত হাসি কান্না সবাইকে বাধভাংগা ধাক্কা না দিলেও ওর স্থিত, প্রত্যয়ী স্বভাবে বলা তো বটেই, সেই বিষয়ের গুরুত্ব ও ভয়াবহতায় সবাই দীর্ঘক্ষন বেশ আচ্ছন্ন থেকেছে।
তারপর যখন খেয়াল হয়, কমলার ছায়া এই কমলা, আর আগেকার, না মধ্যেকার কমলাতে আবার আত্মগোপন করে ফেলেছে, আঁচ করার চেষ্টা করে বুঝতে পারে, কমলার কানে তাদের কোন কথাই আর পৌঁছুবে না, তখন সবাই – সেই কমলা কি বলে গেল, ঝালাই করে নিতে উদ্গ্রীব হয়। কমলা কি বলে গেল, একটি ধাতব বিবমিষাময় কন্ঠস্বর থেকে ওর বাক্যগুলো, কতটা তো এরকমই যে ওর আর মনুষ্য জাতিতে প্রত্যয় নেই। মানুষ কে ভালোবাসায় তার মন উঠে গেছে। এরা ছলনাময়তায় কোথাও কম যায় না। মোস্তফা তাকে আদম হাওয়ার যে কাহিনীটি শুনিয়েছিল, সেখানে বিবি হাওয়ার উপর ক্রমশ রাগ আর আদমের জন্য মমতার উপক্রম হয় কিন্ত কমলার এখন আর এই আদমের বংশধরদের জন্য কোন বাতসল্য হয় না।
সবাই মনে করার চেষ্টা করে, প্রকারান্তরে কমলা কি এই বলে গেল না যে মোস্তফাকে সে আর বিশ্বাস করে না, অথচ ভালোবাসে। এই দোটানায় সে ভেতরে ভেতরে মরছে। মরতে ও রাজী কিন্ত অন্যায় সন্ধি কোন রকম বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন ছাড়াই – কমলার ভালোরকম অপছন্দ। কেন এই মনোজাগতিক বদল? কমলা তখনই বোধকরি, তার মামাবাড়ি ফেরত রেল-বোর্ডিং এ রাত্রিবাসের কাহিনীটি বলে দিয়েছিল।
চাঁদ দেখারত কমলাকে মোস্তফা জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার রোমান্টিক প্রেমের কথা জানায়। সেই সংগ এও ব লে যে তার মা যতই পাত্রী দেখুক, তার মন উঠবে না। সব সমস্যার গন্ডী ডিঙ্গিয়ে সে কমলাকেই বিয়ে করবে। দরকার হলে বাড়ি ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে মাছুয়া নাম ঘোচাবে। বাইরের চেয়ে ঘরের ভেতরের পরিবেশ তখন কমলাকে বেশী নাজুক করে ফেলে। ছোটখাট প্রসঙ্গ বাদ দিলে যা দাঁড়ায় তা হলো সেই রাতে তাদের দুজনের কেউই ঘুমায়নি, কিন্ত তাই বলে পরিপাটি শাদা বিছানাটি ও অস্পৃশ্য থাকেনি। পরবর্তী যে অধ্যায়টুকুতে সবাই কমলার চোখের তারা নিস্প্রভ হতে দেখেছে, ঐ রাতটাই তার অন্যতম কারণ নয়। মোস্তফার ব্যবহার অন্য মাত্রা নিতে সময় নেয় নি, কারণ হিসেবে সবার চোখে ধরা পরার ভয়, কমলার কাছে ও যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে, যা তার কাছে মোস্তফাকে চওড়া নদীর বিশালতায় মুগ্ধ করতে পারেনি। যদিও প্রথম দু চার দিন সে ও মনে প্রাণে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে কিন্ত তারপর স্থানে, অস্থানে, বোন টিউশনিতে, মা পাড়ায় উল বুনতে গেলে, শীতের সন্ধ্যাবেলা ট্রেনের অপেক্ষায় থেকে থেকে মাছের আড়ত ফাঁকা হয়ে গেলে, এমন কি বাবার ভীষন আলসারের অপারেশনের সময় কমলার পাহারায় বাড়ি রেখে অন্যরা জেলা শহরে গেলে- মোস্তফার মূর্তি ক্রমে ক্রমে কমলাকে সন্দেহের ভাবনা ভাবতে বাধ্য করেছিল। ওকে সেসব সময়ে রোষ ওঠা ঘাড় ফোলানো পাড়ার সবার চেনা লাল মোরগটার মত মনে হতে শুরু হলো, যে কিনা যেখানে সেখানে আগপাশ তলা বিবেচনাহীন, নিজের দেয়া যাবতীয় প্রতিশ্রুতি ভুলে কমলাকে কেবলই পেড়ে ফেলতে চায়। আর তখন থেকেই, মোটামুটিভাবে যে সারাংশটা সবার বোধগম্য হয় – তা হচ্ছে, কমলার অসুখের সুত্রপাত। কমলা আসলে মরছিলো তখন থেকেই।
অতঃপর প্রজাপতির সাঁতার
প্রজাপতির সঙ্গে সাঁতরে চওড়া নদীটা পার হবার স্বপ্ন কমলাকে ছাড়ার আগে, কমলাই স্বপ্নটাকে ত্যাগ করলো। প্রজাপতির পাখনার রঙ্গের একটা ওড়না কেনার সাধ ছিল ওর। কিনতে না পেলে ঘরেই বানাবে, রং গুলে গুলে। কল্পনায়, কাঁধের কাছে আটকানো সেফটিপিন থেকে ওড়নার দুপাশ কিভাবে ছড়ালে নিজেকে প্রজাপতির মত দেখাবে, সে মহড়া বহুবার দিয়েছে সে। পাখার ওপর লেপ্টে থাকা তীব্র রোদ যেভাবে শুড়ের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, আর ব্যথাবোধ তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে- কমলা তার হাত, নাভীমূল দিয়ে, বাথরুমে একা ঊন্মুক্ত উরুদ্বয়ে, পায়ের পাতায় ক্রমাগত সেই রোদেলা ব্যথার অস্তিত্ব অনুভব করেছিল। ওড়নার স্বপ্নটা বেমালুম ভুলে যাওয়ার আগে, ব্যথায় অন্ধ চোখ কোন রং বুঝতে পারেনা, তারপরও কমলার মনে হয়, প্রজাপতির মত ঝাঝর রং কতটা দরকার এক জীবনে? কোনটার বেশী দরকার, রংয়ের নাকি ওড়নার? উত্তরে, ব্যথায় ভাসতে ভাসতে, কখনো দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেয়। আর তখনই কমলার অবয়ব জুড়ে নিষ্প্রভ সন্ধ্যা নামে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন