প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে সলিম আলীর। বুকের মধ্য হতে হৃৎপিণ্ডটা ঠেলে বের হয়ে আসতে চাইছে। অনেক কষ্টে এতক্ষণ কাশির বেগটা সামাল দিয়েছেন। এখন আর পারছেন না। হাত দু’টো চরম বিরোধিতা করতে চাইছে। হাতের মধ্যে রিকসার হ্যান্ডেল দু’টো পিছলে যাওয়ার আগে রিকসাটা রাস্তার বাঁ-পাশ ঘেষে দাঁড় করালেন। তারপর সিট থেকে নিমে বসে পড়লেন মাটিতে। বুকে গলার কাছটায় এক হাত আর মাথার উপর এক হাত নিয়ে গেলেন। কাশতে লাগলেন ‘খক খক’ করে। সে কী কাশির দমক!
কাশি এখন থেমে গেছে। কিন্তু সলিম আলী একইভাবে বসে রইলেন। দু’চোখে বিস্ময়। বরং একটু আতঙ্কও ফুটে উঠল সেখানে। তাকিয়ে আছেন সামনে, মাটিতে। একটু আগে কাশির কফ তিনি ওখানেই ফেলেছেন। সাদা গ্যাঁজলা ধরনের কফের মাঝে লালের আভা ফুটে উঠেছে। গতকালও কাশির সাথে ওটা ছিল। তবে তখন ওটার পরিমাণ সীমাবদ্ধ ছিল ফোটা ফোটার মধ্যেই। কিন্তু এখন তিনি যা দেখতে পাচ্ছেন তাতে চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে যাওয়ারই কথা। একদলা লাল রক্ত সলিম আলীর দৃষ্টির সকল শক্তিকে যেন শুষে নিয়েছে।
রিকসায় চ্যাংড়া ধরনের এক প্যাসেঞ্জার ছিল। এতক্ষণ রিকসাওয়ালার কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিল। যদিও তার কোনো তাড়া নেই, তবুও দেরি করার কারণে ভীষণ রাগ হচ্ছিল তার। চেহারাটা কেমন খিটমিটে ধরনের। যে কেউ তাকে একনজর দেখেই বলে দিতে পারবে কিছুতেই ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা তার নেই। বরং সবসময় কেমন একটা ভাবের মধ্যে থাকে। কেমন যেন রুক্ষ রুক্ষ, একটা উড়–উড়– স্বভাব তার সমস্ত দেহে স্পষ্ট।
মাথার ইয়া লম্বা চুলে ডান হাতের আঙুলগুলো চালিয়ে দিচ্ছে বারবার। ওই হাতেরই কব্জিতে শোভা পাচ্ছে পিতলের একটা বালা। সাথে পুঁথির একটা মালাও জড়ানো আছে। লোকটার বাঁ হাতটা দেখে মনে হবে ওটা অকেজো। বাঁ-উরুর উপর ওটা নিশ্চল পড়ে আছে। আসলে তা না, দেখা যাবে সে যখন কথা বলছে তখন ওই হাতটাই বারবার নড়ছে, কথার সাথে তাল মিলিয়ে, মুখের ভাষা প্রকাশে সহযোগিতা করছে।
রিকসা থেকে নেমে এলো প্যাসেঞ্জার ছোকড়া। গিয়ে দাঁড়াল সলিম আলীর পেছনে। সলিম আলী সকল বিস্ময় মাটিতে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। ঘুরলেন প্যাসেঞ্জারের দিকে। চোখে তার নির্বাক আকুতি, ক্ষমা প্রার্থনার বেদনা।
প্যাসেঞ্জার ছোকড়া লম্বায় হয়তো সলিম আলীর চেয়ে একটু খাটোই হবে, কিন্তু সলিম আলী কিছুটা ঝুঁকে থাকায় তাকেই লম্বা মনে হচ্ছে। শার্টের উপরের দু’টো বোতাম খোলা থাকায় ওখান থেকে গলায় ঝোলানো তাবিজের বাণ্ডিলগুলো দেখা যাচ্ছে। বাণ্ডিল বলার কারণ হচ্ছে একসাথে তিন-চারটা তাবিজ সে ব্যবহার করছে। সাথে ব্রাহ্মণের পলতের মতো লাল-সাদায় মিশ্রিত একটা সুতোও দেখা যাচ্ছে। অনেকটা ভারতীয় ক্রিকেটার শ্রীশান্ত’র মতো। তবে এই ছোকড়াটার স্বাস্থ্য একটু ভালো, এই যা।
প্যান্টের পেছনের মানিব্যাগ হাতে নিয়ে টাকা বের করলো ছোকড়া। দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে ধরল সলিম আলীর দিকে। বলল, অনেকটা ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে, ‘এই ন্যাও ভাড়া। রোগ নিয়ে রিকসা চালাও ক্যান্? চিকিৎসে কত্তি পারো না? দেখে তো মনে হয় যক্ষ্মা হয়েছে।’ তারপর চলে গেল এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে।
যতক্ষণ দেখা যায় সেদিকে তাকিয়ে রইলেন সলিম আলী। তারপর হাতে ধরা দশ টাকার নোটটার দিকে একবার তাকিয়ে লুঙ্গির খুট খুলে পলিথিনের ঠোঙাটা বের করে তাতে গুঁজে আবার যথাস্থানে রাখলেন।
সলিম আলী গায়ে খুব জোর পাচ্ছেন না। সব যেন কফের সাথে বের হওয়া ওই রক্তের মাঝেই থেকে গেছে। তার সমস্ত শক্তি কেড়ে নিয়েছে ওই রক্ত। ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখলেন সাদার মাঝে লাল জারক রসটুকু। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিকসায় চড়ে বসলেন। আজ আর রিকসা চালাবেন না।
ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চললেন তিনি।
সলিম আলীর স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল। এই তো মাত্র সেদিনের কথা, চওড়া বুকের ছাতি ছিল তার। হাত ও পায়ের পেশিগুলো ছিল তেমনি ফোলা ফোলা। আর চলার মধ্যেও ছিল একটা রাজকীয় স্টাইল। কিন্তু আজ আর চেহারার সেই জৌলুস নেই তার। শ্যামলা গায়ের বর্ণ কেমন কালচে হয়ে গেছে। কতদিন সেখানে সাবানের ছোঁয়া পড়েনি তা তিনি বলতে পারবেন না। বুকটা এখন অনেকটাই পিঠের দিকে চেপে গেছে। পেশিতে আগের মতো জোর অনুভব করেন না। একটু যেন কুঁজোও হয়ে গেছেন। অথচ বয়স কত হবে তার, সামনের মাসে পঁয়ত্রিশে পড়বে বোধহয়।
দারিদ্র্যের কষাঘাতে সলিম আলী আজ ধুকছেন। কিন্তু তার এই অবস্থা ছিল না। স্কুল শিক্ষক কলিম আলীর একমাত্র সন্তান তিনি।
কলিম আলী এলাকায় ‘মাস্টার মশায়’ বলেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন তিনি। আশপাশের দু’পাঁচটা গ্রাম পর্যন্ত তার সুনাম ছিল। তিনি একজন আদর্শ শিক্ষকও ছিলেন। অনেককে তিনি মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন, অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষ হিসেবে গড়তে সহযোগিতা করেছেন। অথচ নিজের একমাত্র পুত্রকে তিনি পারেননি সঠিকভাবে গড়ে তুলতে। তাহলে চেষ্টা কি তিনি করেননি? না, চেষ্টা তিনি যথেষ্টই করেছেন। কিন্তু সফল হননি। তাই দুনিয়া ছেড়ে চির বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও তিনি চরম আফসোস করে গেছেন।
আসলে কলিম আলী চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। কিন্তু তার স্ত্রী, সলিম আলীর মা, মৌরি বানুর জন্যেই তার চেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি। একথা শুধু তিনি কেন, গ্রামের সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। কলিম আলী ছেলেকে যতবার শাসন করতে গেছেন, ততবারই মৌরি বানু তাতে বাঁধ সেধেছেন। ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি সকল কাজে। ক্লাস ভাইভে পড়ার সময় যখন প্রথম রইস মুন্সির বাগান থেকে পেঁপে চুরি করে ধরা পড়ল, তখনই তিনি ছেলেকে শাসন করতে চেয়েছেন। কিন্তু কিছুই করতে দেননি মৌরি বানু। এর সপ্তাহখানেক পর যখন স্কুলের কাঁচের গেলাস ও জগ বিক্রি করে সিনেমা দেখতে গেল, তখনও ছেলেকে শাসন করতে পারেননি কলিম আলী। ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন সময়ে তার যে অপরাধের শুরু, সেটা মহিরুহু ধারণ করল বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। সিক্সে উঠে স্কুলে অনিয়মিত হলো। দু’বছর থাকল ওই একই ক্লাসে। সেভেনটা টেনেটুনে পার হলেও এইটে ভর্তি হলো না আর। শুরু হলো তার ছন্নছাড়া জীবন।
কলিম আলী ছেলের আশা ছেড়েই দিলেন। অন্যদিকে মায়ের প্রশ্রয় পেয়ে ছেলে উচ্ছন্নে যেতে বসল। এই সময় এক চুরির ঘটনায় জেলেও যেতে হলো তাকে। মৌরি বানুর জোরাজুরিতে ছেলেকে জামিনে ছাড়িয়েও আনলেন কলিম আলী। মা তাকে বোঝানোর ফলে আবার স্কুলে ভর্তি হলো সলিম আলী। বাকি কয়টা বছর পড়াশোনা করে সেকেন্ড ডিভিশনে মেট্রিক পাশ করল ছেলে। মফস্বল শহরের কলেজে ভর্তিও হলো। মূলত সেখান থেকেই তার অধঃপতনের চূড়ান্ত হলো।
বাবা-ছেলের সম্পর্কে আবারও ফাটল ধরল। এই সময় মা-ই আবার এগিয়ে এলেন। ছেলেকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা চালিয়ে যেতে থাকলেন। তার আশা ছিল ছেলে একদিন না একদিন ঠিকই বুঝবে এবং বাপের মান রাখবে।
কলিম আলীও যে ছেলেকে ভালবাসতেন না তা নয়। ভালবাসতেন বলেই তো স্ত্রীর প্রশ্রয়কে মেনে নিয়েছিলেন। তিনিই তো ছেলের জন্য পকেটে টাকা রেখে দিতেন আর মৌরি বানু তা নিয়ে ছেলেকে দিতেন। মনে যে তারও একটা ক্ষীণ আশা ছিল ছেলে একদিন ঠিকই ওপথ ছেড়ে সুপথে চলে আসবে। কিন্তু তা আর হয়নি। একরকম ছেলের চিন্তাতেই মৃত্যুমুখে ঢলে পড়লেন কলিম আলী।
মৌরি বানু ছেলেকে নিয়ে দারুণ বিপদে পড়লেন। ছেলের জন্যই বাপের বাড়ির সাথে একরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তার। তারপরও ছুটে গেলেন তিনি। বড় ভাই বেশ সহযোগিতাও করলেন। কিন্তু তাতে আর কয়দিন চলে! ফলে পরের বাড়িতে ঝুটা ঝিয়ের কাজে লেগে গেলেন তিনি। একদিন ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে হাজির। তাকে পরিচয় করিয়ে দিল নিজের স্ত্রী হিসেবে। প্রথমে রাজী না হলেও ছেলে-বউকে মেনে নিলেন
মৌরি বানু। হয়তো এবার ছেলে পথে ফিরবে। কিন্তু না, যে পাপ তিনি করেছেন, তার প্রায়শ্চিত্ত তো তাকে করতেই হবে।
সংসারে অভাব বাড়তে লাগল। কিন্তু সেদিকে সলিম আলীর কোনো খেয়াল নেই।
ক্রমে কাহিল হয়ে পড়তে লাগলেন মৌরি বানু সংসারের ঘানি টানতে টানতে। বাঁধিয়ে ফেললেন কঠিন অসুখ।
বছর যেতে না যেতেই ঘরে এলো পুত্র সন্তান। মৌরি বানু ভাবলেন, এইবার হয়তো ছেলে একটু মন দেবে সংসারে। কিন্তু সলিম আলী যেন অন্য ধাতে গড়া। কিছুতেই সে সংসারে মন দিল না। সারাদিন বাইরে বাইরে কাটিয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফেরে ছেলে। মৌরি বানু ছেলে-বউকে দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ফল হয়েছে উল্টো, বউকে ধরে পিটিয়েছে সলিম আলী। মৌরি বানু তাই আশা ছেড়েই দিয়েছেন। এখন তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন নাতি ছেলে। ওকে তিনি মানুষের মতো মানুষ করে তুলবেন। ছেলের মতো হতে দেবেন না কিছুতেই। তবে ভেতরে ভেতরে একটা ভয়ও দানা বেঁধে ওঠে তার। শরীরে তো ওরই রক্ত বইছে!
কিন্তু তিনিও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, নাতিকে তিনি মানুষ করবেনই। নিজের ছেলের মতো ভুল তিনি করবেন না। কিছুতেই না।
দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেল। নাতিটাও বেশ বড় হয়ে উঠেছে। একদিন তার হাতে ইয়া বড় বড় দু’টো পেয়ারা দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন সে পেয়ারা কোথায় পেয়েছে। জবাবে কিছুই বলল না নাতি। যা বোঝার বুঝে নিলেন তিনি। বেদম মারধোর করলেন তাকে। যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই-ই হতে যাচ্ছে। সারাদিন ভাবলেন। রাতে ছেলে-বউকে বললেন ছেলে নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে যেতে। এখানে থাকলে ছেলে মানুষ করা যাবে না। অনেক বলা-কওয়ার পর তাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন তিনি। দিন কয়েক পর ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন ছেলে-বউ।
সলিম আলী সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে বউকে আশেপাশে কোথাও দেখল না। এদিকে প্রচণ্ড ক্ষিধেও পেয়েছে। মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। ভীষণ রেগে গেলো সলিম আলী। পরদিন সকালে ছুটলো শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু বউ ফিরে এলো না।
এরপর কেমন যেন হয়ে গেলো সলিম আলী। ভেতরে ভেতরে কিসের সাথে যেন যুদ্ধ করে গেলো ক্রমাগত। বেশিরভাগ সময় ঘরে শুয়ে থাকে। শরীরটাও কেমন শুকিয়ে যেতে থাকল। মা ভাত বেড়ে ঢেকে রাখেন। ইচ্ছে হলে খায়, না হলে ওভাবেই পড়ে থাকে।
মৌরি বানুর শরীরটা এখন বেশ খারাপ। ভারি কোনো কাজই করতে পারেন না। ফলে প্রায় দিনই না খেয়ে থাকতে হয়। খেয়াল করে সলিম আলী। কিন্তু কিছুই বলে না বা করে না। যেন কিছু বলার বা করার নেই তার।
ধীরে ধীরে বিছানা নিলেন মৌরি বানু। খাটে শুয়ে তাকিয়ে দেখে সলিম আলী। মায়ের ‘খক খক’ কাশি শুনে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে।
তারপর বেরিয়ে যায় সলিম আলী। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। রাতে বাড়ি ফিরে মায়ের একই অবস্থা দেখে। খানিক্ষণ শুয়ে থাকার পর সে
রাতেই বেরিয়ে যায় আবার। সারারাত এদিক ওদিক ঘুরেই কাটিয়ে দেয়। সকালে মহাজনের সাথে দেখা করে। অনেক বলা-কওয়ার পর মহাজন
তাকে রিকসা দিতে রাজি হন।
সলিম আলী তাই এখন রিকসাওয়ালা। মফস্বল শহরে রিকসা চালান তিনি। মহাজনকে ভাড়া দিয়ে যা থাকে তা নিয়ে ফেরেন বাড়িতে।
মৌরি বানু এখন বাকহারা। মুখে কিছুই বলতে পারেন না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। আর বুক ফাটিয়ে ‘খক খক’ করে কাশেন।
সলিম আলী সোজা বাড়ি চলে আসেন। আজ তার মনে নতুন একটা ভয় দানা বেঁধেছে। দু’দিন ধরে তার কফের সাথে রক্ত উঠছে। আর মা তো সেই কবে ধরে কাশছেন, তাহলে কি তারও কাশির সাথে...
আর ভাবতে পারেন না সলিম আলী। ব্যথায় গুড়িয়ে যেতে থাকে তার অন্তরটা।
প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগছে সলিম আলী। রিকসাটা বেড়ার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন মায়ের ঘরের দিকে। একপাশে কাঁত হয়ে শুয়ে আছেন তিনি। যেন নিথর একটা দেহ পড়ে আছে। ভীষণ মায়া লাগছে সলিম আলীর।
একবার ভাবলেন মাকে জিজ্ঞেস করবেন তার কাশির সাথে রক্ত ওঠে কি-না। কিন্তু পারলেন না। কোন্ মুখে জিজ্ঞেস করবেন? এতদিন কেন জিজ্ঞেস করেননি?
শুয়ে পড়লেন তিনি, চিত হয়ে। মাথার নিচে দু’হাত রাখলেন। কত কিছুই আজ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কত কত প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। একটারও জবাব তার জানা নেই। তারপরও উঁকি দিয়েই যাচ্ছে। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা। উঁহ্! অসহ্য!
মাথাটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। কপালের দু’পাশের রগ দু’টো দপ দপ করে লাফাচ্ছে। এক হাতে চেপে ধরলেন রগ দু’টো।
কাশি পাচ্ছে। প্রচণ্ড কাশি পাচ্ছে সলিম আলীর। কাশতে গিয়ে থমকে গেলেন। মায়ের কাশি শোনা যাচ্ছে। শুকনো গলায় ‘খক খক’ করে কাশছেন তিনি। শুধু তখনই তার দেহটা একটু নড়েচড়ে উঠছে।
গলার মধ্যে কফ জমা হয়ে রয়েছে। কাশতেই হবে। নইলে... ভয়ও পাচ্ছেন ভীষণ। কাশির সাথে নিশ্চিত রক্ত বেরিয়ে আসবে। লাল রক্ত। বাবার কষ্টের রোজগারের টাকায় তৈরি রক্ত। মায়ের প্রশ্রয়ে তিলে তিলে সৃষ্টি হওয়া রক্ত। ধমনী ও শিরায় বয়ে যাওয়া রক্ত। যে প্রাণশক্তি তার দেহের মাঝে বয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, তাকে সচল রেখেছে, সেই রক্ত!
অতীত দিনের নানান স্মৃতি আজ সলিম আলীর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আবছা ভেসে উঠছে ছেলের মুখটা। ‘ও এখন কত বড় হয়েছে? দেখতে কেমন হয়েছে। আমার মতো না আমারে বাবার মতো? উচ্ছন্নে যাওয়া বখাটে আমার মতো না আদর্শবাদী শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর আমার বাবার মতো?’ মনে মনেই এসব ভাবেন তিনি।
ছেলেটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ওরই তো ছেলে। ওরই রক্তে গড়া দেহ।
রক্ত! আবার সেই রক্ত।
আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সলিম আলী। রক্ত ওকে তাড়া করে ফিরছে। যেন একপাল নেকড়ে বাঘ তার পেছনে ছুটে আসছে। রক্তলোলুপ জিহ্বাগুলো বেরিয়ে পড়েছে রক্তের গন্ধে। টপটপ করে সেখান থেকে লালা ঝরে পড়ছে। হা হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর তেড়ে আসছে।
ছুটছেন সলিম আলী। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছুটছেন। রক্ত বাঁচাতে ছুটছেন।
আবার সেই রক্ত! মুষড়ে পড়লেন তিনি। কিছুটা ঢিল দিলেন ছোটার তালে। তাতে এগিয়ে এলো নেকড়ের পাল। সম্বিৎ ফিরে পেলেন যেন। আবার ছুটলেন।
প্রচণ্ড কাশি পাচ্ছে। তড়াক করে লাফিয়ে নামলেন খাট থেকে। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে কাশতে লাগলেন। কাশির দমকে প্রচণ্ড উঠানামা করছে বুকটা।
হাফাচ্ছেন তিনি। অবশ্য তা থেমেও গেল একটু পর। এখন তাকিয়ে আছেন মাটিতে, রক্তের দলার দিকে। কাশির সাথে শুধুই রক্ত বেরিয়ে এসেছে। কেমন থকথক করছে লোহিত জোযক কলাটুকু। আশপাশ দিয়ে কিছু মাছিও উড়ছে ভনভন করে।
কেশে উঠলেন মৌরি বানু, সলিম আলীর চির দুখী জননী। তার জন্মদাত্রী।
চমকে উঠলেন সলিম আলী। কেমন উদভ্রান্ত হয়ে গেলেন তিনি। কি করবেন এখন?
উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের মধ্যে ছোটাছুটি করতে লাগলেন।
সলিম আলীর ছেলের শরীরেও বইছে একই রক্ত। না, নিরাপদে থাক ছেলে। নিরাপদে থাক তার রক্ত। ওই রক্ত কিছুতেই দূষিত হতে দিতে চান না তিনি।
সলিম আলী এখন ঘরের মেঝেয় পড়ে থাকা এক থোকা রক্তের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কয়েকটা মাছি ভনভন করছে তার উপর।
সূত্র : সোনার বাংলাদেশ
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন