ভূমিকা
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৬ সেল নামক ১২ কামরা বিশিষ্ট দীর্ঘ দালানের এক নম্বর কামরায় আমার ১৬ মাসের জেল জীবন কাটাই। দিনের বেলা আমার কামরার সামনে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে একজন সিপাই সব সময় ডিউটিরত থাকত।সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পালাক্রমে দু'জন সিপাই ৬ ঘন্টা করে অবস্থান করত। রাতে প্রত্যেকের ৩ ঘন্টা করে ডিউটি করতে হত। দীর্ঘ ৬ ঘন্টা সময় তাদের যেভাবে কাটত তা দেখে আমার মায়াই লাগত। কখনো একটু পায়চারী করে, কোন সময় বারান্দার লোহার সিক ধরে দাঁড়িয়ে, এক সময় দেয়ালে হেলান দিয়ে, মাঝে মাঝে বসে একটু ঝিমিয়ে কোন রকম সময়টা পার করত হতো। ২৬ সেলের চাবির ছড়া হাতে ডিউটিরত অপর একজন সিপাইর সাথে গেটের সিঁড়িতে বসে আলাপ করা কালে তার সময়টা ভালই কাটত বলে মনে হয়। আমি আলাপ করলে খুব খুশি হত।
ঐ এলাকার জমাদার এ দু'জন সিপাইর সাথে গল্পরত অবস্থায় দেখলে আমি কয়েকজনকে একসাথে পেয়ে জিজ্ঞেস করতামঃ আপনারা ডিউটিতে থাকাকালে শরীরটাতো দাঁড়িয়ে, বসে বা হেঁটে সময় কাটান, কিন্তু মনটা এসময় কোথায় থাকে এবং কী করে? প্রশ্ন শুনে একে অপরের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে আমার দিকে অসহায় চোখে তাকালে আবার ঐ প্রশ্নই করতাম। তখন একটু ভেবে পাল্টা প্রশ্ন করতঃ মনে হাজারো চিন্তা ভাবনা তোলপাড় করতে থাকে- পারিবারিক বিষয়, চাকুরীতে সমস্যা, অভাব অনটন নিয়ে দুশ্চিন্তা, আজেবাজে কত কথা যে মনে জাগে এর কি কোন হিসাব থাকে? আবার প্রশ্ন করতামঃ আচ্ছা, এসব ভাবনা-চিন্তা কি নিজে নিজেই এসে ভীড় জমায়, না সচেতনভাবে একটা একটা করে বিষয় নিয়ে ভাবেন? একটু হেসে জওয়াব দিতঃ এর কোন ঠিকানা নেই। কখন যে কোন কথা মনে হাজির হয়ে যায় তা টেরও পাওয়া যায় না।
প্রথমতঃ এদের কথা বিবেচনা করেই আমার মনে খেয়াল আসল যে মনটাকে সচেতনভাবে কাজ না দিলে শয়তান সহজেই খালি মনটাকে দখল করে বসে । শুধু পুলিশ, সিপাই, দারোয়ানের বেলায়ই নয় সবার ব্যাপারেই এ কথা সত্য। তাই মনটাকে কাজ দেবার গুরুত্ব অনুভব করে এ পুস্তিকাটি রচনা করা হয়। আমার জেলে থাকাকালে এ লেখাটি মাসিক প্রথিবীতে প্রকাশিত হয়। এখন তা পুস্তিকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আশা করি পাঠক -পাঠিকাগণ পুস্তিকাটি পড়ে উপকৃত হবে। আল্লাহ পাক এ লেখাটির উদ্দেশ্য সফল করুন।
গোলাম আযম, আগস্ট -১৯৯৩ ইং
মনটাকে কাজ দিন
আপনার দেহকে শোয়া, বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটানো ইত্যাদি যে অবস্থায়ই রাখুন, সকল অবস্থায়ই আপনার মন কাজ করতে থাকে। এমনকি দেহ যখন ঘুমে অচেতন থাকে তখনো মন কাজ করতে থাকে। সে ঘুমায় না। মনোবিজ্ঞানীরা স্বপ্নকে মনের কর্মব্যস্ততা বলে ব্যাখ্যা করেছেন । দেহ যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে, মন তখন আরো সক্রিয় হয়। দেহ তখন ক্লান্ত ও হয় না, বিশ্রামও নেয়না।মনোবিজ্ঞানীরা মনের বিশ্লেষণ এবং চেতন, অবচেতন ও অচেতন মনের ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যাপক চর্চা করেছেন। আমার আলোচ্য বিষয় তা নয়। আমরা সবাই এর ভুক্তভোগী যে আমাদের সজাগ সচেতন পরিকল্পনা ছাড়াই মনে হাজারো কথা জাগে। সুচিন্তা, কুচিন্তা, দুশ্চিন্তা সব সময়ই মনে ভীড় করেই থাকে। গাড়িতে হোক আর বাড়িতেই হোক, চুপ করে হয়তো বসে আছেন। মন কিন্তু চুপ নয়। কত আজেবাজে, খেই ছাড়া, খেই হারা, অগণিত কথা সে বুনেই চলেছে। হাতে কাজ করছেন আর আপনার বিনা ইচ্ছায় এমন সব কথা মনে জাগছে যা হয়তো আপনি মন থেকে তাড়াতে চান। শুদ্ধ উচ্চারণে নামাযে সূরা কিরআত পড়ছেন, আর মন কোথায় যে ছুটাছুটি করছে তার হিসাব নেই। কোন কোন সময় এমন বে খেয়াল মনে জাগে যা বিবেকের নিকট লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ সবই আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা।
আমরা যখন মনোযোগ দিয়ে বই পড়ি তখন বই এর আলোচ্য বিষয়ের বাইরের কোন কথা মনে ঢুকবারই ফাঁক পায় না । যখন একাগ্রচিত্তে কারো বক্তৃতা শুনি তখন অন্য কোন ভাব মনে জাগে না। যখন কোন কাজের পরিকল্পনা করতে বসি তখন মনে ভিন্ন চিন্তা স্থান পায় না । কোন বিষয়ে যখন গবেষণায় লিপ্ত তখনও বাইরের চিন্তা জাগবার সুযোগ পায় না। কোন বিশেষ ভাব যখন লিখে প্রকাশ করার চেষ্টা করি তখন ভিন্ন ভাব মনে কোন পাত্তাই পায় না। এ দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মনকে সচেতনভাবে কোন কাজে ব্যস্ত রাখলে অনুগত হয়ে সে কাজ করতে থাকে। কিন্তু যখনই তাকে কোন কাজ দেয়া হয় তখন সে নিজেই কাজ যোগাড় করে নেয়। কারণ সে যে বিনা কাজে থাকতে পারেনা।
বিখ্যাত ইংরেজী প্রবাদ: “Empty mind is devil’s workshop” (শূন্য মন শয়তানের কারখানা ) কথাটি বড়ই তিক্তসত্য । অর্থাৎ মনকে কর্মহীন অবস্থায় রাখা হলে সে খালি থাকবে না। ইবলিশ তাকে কাজ দেবেই। যেহেতু সে বিনা কাজে থাকতে পারে না সেহেতু ইবলিশের দেয়া কাজই সে করতে থাকে। রাসূল (সা.) বলেছেন, মানুষ এমন এক ঘোড়া যার পিঠ কখনো খালি থাকেনা। যদি সে সব সময় আল্লাহকে তার পিঠে সওয়ার করিয়ে রাখে তাহলে সে নিরাপদ। যখনই তার পিঠ খালি হয় তখনই ইবলিশ চেপে বসে। তাই ইবলিশ থেকে বেঁচে থাকতে হলে পিঠ কখনো খালি রাখা চলব না। সকল অবস্থায় সচেতনভাবে কথা, কাজ ও চিন্তায় আল্লাহর আনুগত্য করতে থাকলে ইবলিশের আনুগত্য করার সুযোগ পায় না।
আমরা যদি আমাদের মনকে শয়তানের কারখানা হওয়ার শোচনীয় পরিণাম থেকে রক্ষা করতে চাই তাহলে মনটাকে হামেশা কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সচেতনভাবে তাকে সব সময় কাজ দিতে থাকব। বিনা কাজে কোন সময়ই তাকে থাকতে দেবো না।
এ কথাটা বলা যত সহজ বাস্তবে করা ততই কঠিন। এর জন্য রীতিমতো অনুশীলন ও অভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়। কিন্তু অনুশীলন ও অভ্যাসের জন্য যে নির্দেশনা দরকার তা কোথায় ও কিভাবে পাওয়া যাবে সে প্রশ্নটিই প্রধান। এত বড় একটা বিষয় নিয়ে বছর বছর চিন্তা ভাবনা করেও কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। মনকে অনুগত করার কঠিন কাজ আর নেই । যে কাজ দেবো তাই করতে হবে, আর কোন কাজ করতে দেবো না, এমন কর্তৃত্ব মনের উপর হাসিল করা অসাধ্য ব্যাপার। মনকে সব সময়ই ইতিবাচক কাজ দেবার সাধ্য কার ? ২৪ ঘন্টার জন্য এ বিষয়ে রুটিন তৈরি করে সে অনুযায়ী মনকে পরিচালনা চরম দুঃসাধ্য সাধন বলেই আমার অভিজ্ঞতা।
মন কি চায়
মানব সত্তা বড় বিচিত্র । অনেক সময় বা কোন কোন সময় মন এমন কিছু পেতে চায় যা বিবেক সমর্থন করে না। এতে স্পষ্ট বুঝা গেল যে , মানব সত্তা একক নয়। মানুষের দুটো সত্তা রয়েছে। একটি দেহসত্তা, অপরটি নৈতিক সত্তা। দেহ হলো বস্তুসত্তা । দুনিয়াটাও বস্তুসত্তা। বস্তুজগতের কতক উপাদানেই মানব দেহ গঠিত। তাই বস্তুজগতের প্রতি মানবদেহের প্রবল আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক। এ পৃথিবীতে ভোগ করার মতো যা কিছু আছে তাই দেহ পেতে চায়। দেহের মুখপাত্রই হলো মন। দেহ যা চায় তাই মনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সুতরাং বুঝা গেল যে, মন যা চায় তা দেহেরই দাবী।কুরআন পাকে দেহের দাবীর নাম দেয়া হয়েছে 'নাফস'। নাফস মানে দেহের দাবী । নাফসের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেনঃ 'নিশ্চয়ই নাফস মন্দের দিকে প্ররোচনা দেয়।' (সূরা ইউসুফ ৫৩ আয়াত) অর্থাৎ দেহের যেহেতু কোন নৈতিক চেতনা নেই সেহেতু সে দাবী জানাবার সময় উচিত বা অনুচিত কিনা তা বিবেচনা করতে পারে না। তাই এটা নিশ্চিতভাবে ধরেই নিতে হবে যে দেহের সব দাবীই মন্দ। অবশ্য বিবেক যদি দেহের কোন কোন দাবীকে মন্দ নয় বলে স্বীকার করে তাহলে কোন সমস্যা নেই। ভাল মন্দের বিচার কে করবে?
মানুষের বিবেক বা নৈতিক সত্তাই দেহের দাবী সম্পর্কে বিচার বিবেচনা করে। এ বিবেকই হলো আসল মানুষ। কুরআনের ভাষায় একেই বলা হয় রূহ । দেহ হলো বস্তুগত হাতিয়ার যা মানুষকে ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। এ বস্তুজগতকে কাজে লাগাবার জন্য বস্তুগত হাতিয়ার জরুরি । কিন্তু হাতিয়ার সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে উদ্দেশ্য সফল হয়না।
দেহ হাজারো দাবি করতে পারে। কিন্তু তাকে কষে লাগাম লাগাবার যোগ্যতা যদি রূহ বা বিবেকের থাকে তাহলে এ দেহ ঘোড়াই দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেবে। ঘোড়াকে বাদ দিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। ভালভাবে ঘোড়ার যত্ন নিতে হবে, ওকে সুস্থ ও সবল রাখতে হবে। কিন্তু ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা না থাকলে আরোহীর জীবনই ব্যর্থ।
মনের উপর লাগাম লাগাবার উপায় কী?
এ বিষয়ে ইতিপূর্বেই মন্তব্য করেছি যে, বহু বছর চিন্তা করেও কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। কেমন করে কুল কিনারা পাব? এ সমস্যার সমাধান দেবার জন্য যে আল্লাহর রাসূল প্রয়োজন । যে সমস্যার সমাধানের জন্য আল্লাহতাআলা রাসূল পাঠাবার প্রয়োজন মনে করেছেন, সে সমস্যা আর কে সমাধান করতে পারে ? দেহযন্ত্র যে আল্লাহ তৈরী করেছেন, তিনিই এর ব্যবহার পদ্ধতি রাসূলের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। মনের উপর লাগাম লাগাবার ইচ্ছা কারো থাকলে রাসূল (সা) এর কাছ থেকেই শিখতে হবে। এর আর কোন বিকল্প নেই।বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু মনীষী তাদের প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, কবি-সাহিত্যিক, শিল্প সংগঠক, সমাজ সেবক ইত্যাদি ক্ষেত্রে যারা বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন, তারাও মনকে নিয়ন্ত্রণ করার বিজ্ঞানসম্মত বাস্তব কোন উপায় আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। কারণ এ কাজটির জন্য গবেষণা ও সাধনা যথেষ্ট নয়। এর জন্য রিসালাত ও নবুওয়াত প্রয়োজন । নবী ও রাসূলগণ যে জ্ঞান লাভ করেন তা তাদের সাধনা ও গবেষণার ফসল নয়। তা আল্লাহর দান যা তিনি নবী-রাসূলগণকেই দিয়ে থাকেন ।
নবী-রাসূলগণের বাস্তব শিক্ষার নাগাল না পেয়ে যারা এ সমস্যার সমাধানে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তারা বৈরাগ্যের মাঝেই এর একমাত্র সমাধান তালাশ করেছেন। কিন্তু এটাতো আসলে কোন সমাধানই নয়। তারা দেহের দাবিকে অস্বীকার করে মনকে মেরেই ফেলেন । মরা ঘোড়া কী কাজে আসবে?
নবী-রাসূলগণ মানুষকে বৈরাগী বানাতে আসেননি। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন যে 'গোটা বস্তুজগতকে তিনি মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি করেছেন' (সূরা আল বাকারাহ ২৯ আয়াত)। আর এ জগতকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যেই মানুষকে দেহযন্ত্রটি দেয়া হয়েছে। বৈরাগ্য আল্লাহর উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিরোধী। রাসূলগণ মানুষকে এ বস্তুজগত ও দেহযন্ত্রকে আল্লাহর পছন্দনীয় পন্থায় ব্যবহার করার পদ্ধতিই শিক্ষা দিয়েছেন। এ শিক্ষা সকল মানুষের পক্ষেই গ্রহণ করা সম্ভব । তাঁরা কোন অবাস্তব শিক্ষা দেননি।
বিভিন্ন ধর্মের একনিষ্ঠ সাধকগণ বৈরাগ্য সাধনের মাধ্যমে এ কথাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, দেহকে বস্তুজগতের সকল প্রকার ভোগ থেকে বঞ্চিত করা ছাড়া আত্মার বা নৈতিকতার উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তারা কেবল দুনিয়ার সকল আকর্ষণ পরিত্যাগ করার মাধ্যমেই মনকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব মনে করেন। এ অবাস্তব পদ্ধতি গুটিকয়েক লোক গ্রহণ করতে পারে । এটা মানুষের প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবাস্তব বিদ্রোহ মাত্র।
তারা ধরেই নিয়েছেন যে, বিবাহিত জীবনের স্বাদ ভোগ করে মনকে পরনারীর লোভ থেকে রক্ষা করা অসম্ভব। সুস্বাদু খাদ্য খেয়ে হারাম কামাই থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাদের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা অস্বীকার করার মতো নয়। রাসূলের শিক্ষা গ্রহণ করার সৌভাগ্য যাদের হয়নি তাদের পক্ষে পবিত্র জীবন লাভের উদ্দেশ্যে বৈরাগ্য সাধনের পথ বেছে নেয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই বৈরাগ্য সাধকদের প্রতি আমি অশ্রদ্ধা পোষণ করি না । রূপ, রস, গন্ধে ভরা দুনিয়ার আকর্ষণ ত্যাগ করা কোন খেলা নয়। অন্য একটি প্রবল আকর্ষণ না থাকলে এটা করা সম্ভব হতো না। অবশ্য এ পথ মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
মুসলিম ধর্ম সাধকদের মধ্যেও এ প্রবণতা বিভিন্নরূপে লক্ষ্য করা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ায় আল্লাহর খেলাফত কায়েমের যে আদর্শ রেখে গেছেন সে কঠিন পথ ত্যাগ করে এবং বাতিল শক্তির সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে আল্লাহর অলী হবার সাধনা যারা করেন, তাদের পথ আর যাই হোক রাসূলের সত্যিকার অনুসরণ নয়।
রাসূল (সাঃ) এর শেখানো পথ
আল্লাহ পাক মানুষের মধ্যে এ যোগ্যতা দান করেছেন যে, সে জীবনের জন্য যখন কোন একটা লক্ষ্য স্থির করে নেয় তখন ঐ লক্ষ্য হাসিলের জন্য যত শ্রম, সাধনা ও ত্যাগ তিতিক্ষা প্রয়োজন তা সে হাসিমুখে বরণ করে নিতে পারে । এ যোগ্যতা না থাকলে মানুষ জীবন সংগ্রামের কোন স্তরই অতিক্রম করতে পারতো না।স্বাধীনতার সংগ্রামে দীর্ঘ কারাযন্ত্রণা ভোগ করা, এমনকি মৃতু্যর পরওয়া পর্যন্ত না করা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও সাধনায় সকল আরামকে হারাম করে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করা, বড় ব্যবসায়ী হবার জন্য রাত দিন এক করে কঠোর পরিশ্রম করা ইত্যাদি এ কথাই প্রমাণ করে যে, লক্ষ্য স্থির করার সিদ্ধান্ত নিলে তা হাসিল করতে সবরকম কষ্ট বরণ করা সম্ভব।
আল্লাহর রাসূলগণ তাই প্রথমেই গোড়ায় হাত দিয়েছেন । মানুষকে তার জীবনের মূল লক্ষ্য স্থির করার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ডাক দিয়েই তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। কুরআন পাকের কয়টি সূরা বিশেষ করে সূরা আল আ'রাফ ও সূরা হুদে বেশ কয়েকজন রাসূলের নাম উল্লেখ করে প্রমাণ করা হয়েছে যে, সকল রাসুল মানব সমাজকে একই কথা কবুল করার দাওয়াত দিয়েছেন। সে কথাটি হলোঃ 'হে আমার কাওম! একমাত্র আল্ল্লাহর হুকুম মেনে চল । কারণ তিনি ছাড়া আর কেউ হুকুমকর্তা হবার যোগ্য নেই।' এ দাওয়াতই হলো তাওহীদের দাওয়াত।
এ ডাকে তারাই সাড়া দিয়েছে যারা আল্লাহকে একমাত্র হুকুমকর্তা মেনে চলার জন্য প্রস্তুত হয়েছে এবং আল্ল্লাহর হুকুম বিরোধী কারো হুকুম না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা রাসূলগণের এ প্রথম দফা দাওয়াত কবুল করেছে তাদেরকে যে দ্বিতীয় দাওয়াত দেয়া হয়েছে, তা বিভিন্ন সূরায় উল্ল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে সূরা আশ-শুয়ারায় বিভিন্ন নবীর নাম উল্ল্লেখ করে দেখানো হয়েছে যে, সকল নবীই এ দাওয়াত দিয়েছেন । এ দ্বিতীয় দফা দাওয়াতের ভাষা হলোঃ 'আল্লাহকে ভয় কর, তিনি যা অপছন্দ করেন তা থেকে বেঁচে থাক এবং আমাকে মেনে চল।'
দ্বিতীয় দফা দাওয়াতের মাধ্যমে রাসূলের নেতৃত্ব মেনে নেয়ার জন্যে ঐসব লোককে নির্দেশ দেয়া হলো যারা তাওহীদকে কবুল করে নিয়েছে । এ দ্বিতীয় দাওয়াতটি হলো রিসালাতের দাওয়াত । যে রিসালাতকে কবুল করলো সে এ সিদ্ধান্তেই নিল যে, আমি আল্লাহর হুকুম একমাত্র রাসূল থেকেই জেনে নেব এবং তিনি যেভাবে ঐ হুকুম পালন করা শিক্ষা দেন একমাত্র ঐ তরীকাই মেনে চলব। আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্য রাসূল ছাড়া আর কারো কাছ থেকে ভিন্ন কোন তরীকা গ্রহণ করব না।
যারা তাওহীদ ও রিসালাতকে কবুল করে নিল তাদেরকে সংগঠিত করে রাসূল (সা) এ দুটো দাওয়াত জনগণের মধ্যে প্রসারিত করতে লাগলেন। রাসূল (সা) নিজে এবং যারা তাঁর দাওয়াত কবুল করলেন তারা সবাই রাসূলের নেতৃত্বে তাওহীদ ও রিসালাতের দাওয়াতকে একটি আন্দোলনে রূপদান করেন। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো সমাজে আল্লাহর প্রভুত্ব ও রাসুলের নেতৃত্ব কায়েম করা অর্থাৎ দেশ ও সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব এমন লোকদের হাতে আনা প্রয়োজন, যারা আল্লাহর মরযী মতো দেশকে চালাবে। যারা এভাবে রাসূলের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে রাযী হলেন তাদেরকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলো যে, এ পথে সংগ্রাম করা ও আসল উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের সাফল্য। দুনিয়ার সাফল্য আসল টার্গেট নয় । আখিরাতের টার্গেটকে সামনে রেখে যারা এ পথে চলবে একমাত্র তাদের উপরই আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন এবং পরকালে তারাই বেহেশতের চিরস্থায়ী সুখ শান্তি লাভ করতে পারবে।
তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত হলো রাসূলগণের মূল দাওয়াত । মানব সমাজ এর ভিত্তিতে পরিচালিত হলেই মানুষ দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি লাভ করতে পারবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তর ও পর্যায়ে যারা আগে থেকেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দখল করে আছে তাদেরকে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের দাওয়াত দেয়া হল। কারণ তারা এ দাওয়াত কবুল করলে বিনা বাধায় সমাজ রাসূলের দেখানো পথে চলতে পারবে। সব যুগেই নবীগণ নেতৃস্থানীয়দের এ উদ্দেশ্যেই বিশেষভাবে দাওয়াত দিয়েছেন।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী যে, নেতৃত্বের অধিকারীরা এ দাওয়াত কবুল করতে রাযী হয়নি বলে তাদের সাথে নবীদের সর্বাত্মক সংঘর্ষ হয়েছে। নবী ও তাঁর সাথীদের উপর হাজারো রকমের নিযর্াতন চালানো হয়েছে। হক ও বাতিলের এ সংঘর্ষের মাধ্যমেই ইসলামী আন্দোলনে শরীক জনশক্তির মধ্যে প্রয়োজনীয় গুনাবলী সৃষ্টি হয়েছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে আল্ল্লাহর বিধান অনুযায়ী গড়ে তুলবার জন্য প্রয়োজন।
একটু ভেবে দেখুন
নবী রাসূলগণের দাওয়াত কবুল করে ঐ পদ্ধতিতে যারা ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং বাতিল শক্তির মোকাবিলায় সদা সতর্ক থাকতে বাধ্য হয়, তাদের মন স্বাভাবিক কারণেই ভিন্ন চিন্তার জন্য কমই খালি থাকে। ইসলামী আন্দোলনের দেয়া পদ্ধতি অনুযায়ী তাদের ২৪ ঘন্টার রুটিন প্রণয়ন করতে হয়। নিজেদের জীবনকে এভাবেই আল্লাহর সৈনিক হিসাবে তারা গড়ে তুলবার চেষ্টা করেন। এর ফাঁকেই পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। পেশার ঝামেলা তো পোহাতে হয়ই। বাতিল শক্তির সৃষ্ট বাধা বিপত্তির প্রতিকারের উদেশ্যে আন্দোলন হঠাৎ করেই যেসব কর্মসূচী ঘোষণা করে তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাদের মনে বাজে চিন্তা ঢুকবার অবকাশ কোথায়? যে পথে চলার সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছেন তা তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।যারা আন্দোলনে শরীক নয়, তাদের পক্ষে আল্লাহর পথের এ মুজাহিদের দৈহিক ও মানসিক ব্যস্ততা সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা কঠিন। তাদের মনে কুচিন্তা, বাজে খেয়াল, ভিন্ন ভাব ঢুকাবার জন্য ইবলিশের পক্ষে তেমন সুযোগ পাওয়ার কথা নয়।
তবু অনৈসলামী সমাজ ব্যবস্থার দরুণ তাদের ঈমান, আকীদা, রুচি ও পছন্দের বিরোধী পরিবেশে তাদের মনকে পবিত্র, রাখার জন্য সদা সতর্ক থাকতে হয়। পরিবারে, সামাজিক অনুষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, পথে-ঘাটে, যানবাহনে, হাটে-বাজারে তাদেরকে বিপরীত পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়। আর দশজনের মতোই রক্ত মাংসে গড়া দেহের দাবি তাদেরকেও তাড়া করা স্বাভাবিক। তাই এসব অবস্থায় মনকে পবিত্র রাখার জন্য বিশেষ যত্ম নিতে হয়। এখানে কবি রবীন্দ্রনাথের 'জুতা-আবিষ্কার' নামক কবিতাটি থেকে চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যায়। এক রাজা তার রাজ্যের ধুলাবালি থেকে পা দুটোকে রক্ষা করার জন্য রাজ দরবারে পরামর্শ চাইলেন। চামড়া দিয়ে সব রাস্তাঘাট ঢেকে দেয়ার পরামর্শসহ বিভিন্ন রকম মতামত প্রকাশ করা হয়। এভাবেই জুতা আবিষ্কার করা হয় বলে ঐ কবিতায় একটা রূপক গল্পের অবতারনা করা হয়েছে।
সমাজের সর্বত্র যে অপবিত্রতা বিরাজ করছে, তা থেকে মনকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে পবিত্রতার চামড়া দিয়ে মনের জন্য মোড়ক তৈরি করাই একমাত্র উপায় । এ ব্যাপারে রাসূল (সা) নিম্নরূপ ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন যা সত্যিই অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তবভিত্তিক।
মনকে বশে আনার উপায়
১. পাঁচ ওয়াক্ত জামায়াতে নামায আদায় করা। দিন রাতে ২৪ ঘন্টার যাবতীয় কার্যক্রম নামাযকে কেন্দ্র করে রচনা করতে হবে। ফযরের নামায দিয়ে রুটিন শুরু । এর আগে আর কোন কাজ নয়। টয়লেট, অযু - গোসল তো নামাযেরই প্রস্তুতি।কালেমা তাইয়্যেবার মাধ্যমে জীবনের যে পলিসি ঠিক করা হয়েছে তা হলো আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা অনুযায়ী চলার সিদ্ধান্ত। নামায এ সিদ্ধান্ত অনুসারে চলারই ট্রেনিং । মন, মগয, অংগ-প্রত্যংগ দ্বারা নামাযে যা কিছু করা হয় তা সবই আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা অনুযায়ী। এর অন্যথা হলে নামায বাতিল বলে গণ্য হয়।
নামাযের মাধ্যমে প্রধানতঃ তিনটি শিক্ষা দেয়া হয়ঃ
(ক) তুমি আল্লাহর গোলাম হিসাবে সকল সময় সব অবস্থায় জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তাই নামাযে যেভাবে তোমার মন, মগয, দেহ আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকায় পরিচালনা করেছ নামাযের বাইরেও সেভাবে চলতে হবে।
(খ) তুমি যে আল্লাহর দাস সে কথা হামেশা মনে রাখার প্রয়োজনেই নামায আদায় করতে হয় 'আমার কথা স্মরণ রাখার জন্য নামায কায়েম কর'। ( সূরা তোয়াহা ১৪ আয়াত)
নামায শেষে হালাল রোজগারের জন্য যখন কর্মব্যস্ত হবে তখন আল্লাহকে ভুলে যাবে না। বরং 'আরও বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো'। (সূরা জুমআ : ১০আয়াত)
আল্লাহকে স্মরণ রাখার উদ্দেশ্যেই ২৪ ঘন্টার কার্যক্রমে প্রতিটি ফরয নামায জামায়াতে আদায় করতে হবে। এর জন্যই বাইরে কর্মব্যস্ত থাকা কালেও মনটাকে মসজিদেই ঝুলিয়ে রাখতে হবে। হাদীসে আছেঃ ৭ ব্যক্তি হাশরের ময়দানে আল্লাহর রহমতের ছায়ায় থাকবে । তাদের একজন হলো 'ঐ ব্যক্তি যার মন মসজিদে ঝুলন্ত।' অর্থাৎ শত কাজের ঝামেলার মধ্যেও মসজিদে জামায়াতে ফরয নামায আদায়ের ধান্দা তার লেগেই থাকতে হবে। এভাবে ৫ ওয়াক্ত জামায়াতে নামায তার মনে আল্লাহর যিকর তাজা রাখে। নামায তাকে আল্লাহকে ভুলতে দেয় না। নামাযে মনকে আটকে রাখার চেষ্টা করতে থাকাই আমাদের কর্তব্য। বারবার মনোযোগ ছুটে গেলেও নিরাশ হওয়া উচিত নয়। ইচ্ছা করে অন্য চিন্তা না করলে এবং মনোযোগকে ধরে রাখার সাধ্য মতো চেষ্টা করতে থাকলে আশা করা যায় যে, অনিচ্ছাকৃতভাবে মনোযোগ ছুটে গেলেও আল্লাহ পাক ক্ষমা করবেন। কারণ আল্লাহ পাক সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপান না।
(গ) নামাযের তৃতীয় বড় শিক্ষা হলো অশ্লীল ও হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করা।
'নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও হারাম কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে।' (সূরা আল আনকাবুত ৪৫ আয়াত)
নামাযীকে তাই সব সময় সচেতন থাকতে হয় যে, অশ্লীল ও হারাম কাজ যেন হয়ে না যায়, তাহলে তো আল্লাহ তার নামায কবুল করবেন না। ঐ নামাযই আল্লাহর নিকট কবুল হবার যোগ্য যে নামায অশ্লীল ও হারাম থেকে ফিরাতে পারে। উপরের আয়াতে এ কথাই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
২. শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামায ''আসলে রাত জাগা নাফসকে দমন করার জন্য খুব বেশি ফলদায়ক এবং কুরআন ঠিকমতো পড়ার জন্য বেশি উপযোগী।" (সূরা আল মুজ্জাম্মিল ৬ আয়াত) তাহাজ্জুদের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে মহব্বতের যে ঘনিষ্ঠতা জন্মে এর কোন বিকল্প নেই। এ মহব্বতের হাতিয়ারই মনকে ইবলিশের হামলা থেকে রক্ষা করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
দুনিয়া যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন ঘুমের মজা ত্যাগ করে যে মনিবের দুয়ারে ধরণা দেয়, তার মনে আল্লাহর মহব্বত বৃদ্ধি পায়। রাসূল (সা) তাহাজ্জুদের নামায সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন 'এটা সালেহ লোকদের তরীকা, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়, অতীত গুনাহর কাফফরা ও ভবিষ্যত গুনাহর নিরাপত্তা।'
তাহাজ্জুদের নামায আদায়ের ফাঁকে ফাঁকে বা শেষে নিজের গুনাহ মাফের জন্য তাওবা করলে চোখের পানির বৃষ্টিতে মনের আকাশে জমাট গুনাহর মেঘ কেটে যায় এবং ঈমানের সূর্য আগের চেয়েও উজ্জ্বল হয়। আল্লাহর দরবারে কাঁদতে পারার স্বাদই আলাদা। তাওবার পর মনিবের কাছে চাওয়ার পালা। দ্বীন ও দুনিয়া এবং আখিরাতের সবকিছুই চাইতে হবে।
বিশেষ করে মাবুদের নিকট গোলাম হিসাবে স্বীকৃতি দাবী করে কাঁদতে আরও মজা লাগে।
৩. রমযানের রোযা প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ এ তিন দিনের রোযা, শাওয়াল মাসে এ তিনটি ছাড়া আরও তিনটি রোযা, আশুরার দুটো এবং আরাফার দিনের রোযা সারা বছর রোযাদারকে নাফসের উপর নিয়ন্ত্রণের যোগ্য বানায়।
৪. সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ রাখাঃ এর জন্য রাসূল (সা) যে সহজ পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন তা হলো প্রত্যেক অবস্থায় এর উপযোগী দোয়া পড়া। রাসূল (সা) এর শেখান আরবী দোয়া অর্থসহ শিখতে পারলে তো কোন কথাই নেই। অন্ততঃ দোয়ার অর্থটুকু মনে জাগরুক রাখা দরকার। ঘুমাবার ও ঘুম থেকে জাগার সময়, টয়লেটে যাবার ও ফিরে আসার সময়, অযুর শুরু ও শেষে, খাওয়ার শুরু ও শেষে, বাড়ি থেকে বের হবার ও বাড়িতে ফিরে আসার সময়, বাজারে চলার সময়, যানবাহনে উঠার ও নামার সময় ইত্যাদি সব অবস্থায়ই রাসূল (সা) দোয়া পড়তেন।
৫. রাসূল (সা) মনকে সব সময় আল্লাহর যিকর (স্মরণ ) মশগুল রাখার উপায় হিসাবে জিহ্বাকেও যিকরে ব্যস্ত রাখার উপদেশ দিয়েছেন। যখনি ইতিবাচক চিন্তা -ভাবনা থেকে মনটা খালি হয়ে যায় তখনি তিন তসবীহ, কালেমা তাইয়্যেবা, দরূদ ইত্যাদি মুখে জারী রাখার সাথে সাথে মনে ও সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এভাবে মনকে সব অবস্থায়ই কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। শয়তান থেকে মনকে বাঁচাবার জন্য এর কোন বিকল্প নেই।
মুখ ও মনকে একসাথে কাজ দিতে হবে
এ তিক্ত অভিজ্ঞতা সবারই আছে যে নামায পড়া, তসবীহ জপা এবং যিকর করার সময় মুখে ঠিকই উচ্চারণ করা হচ্ছে, কিন্তু মনে অন্য কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। দেহ জায়নামাযে দাঁড়িয়ে সূরা পড়ছে আর মন কোথায় ছুটাছুটি করছে। মুখে তসবীহ উচ্চারণ করা হচ্ছে এবং হাতের আঙ্গুলও তসবীহ দানা টেনে নিচ্ছে বটে কিন্তু মন অন্য বিষয় ভেবে চলেছে।অথচ বক্তৃতা করার সময় মুখ যা বলছে মনও তাই বলছে। বই পড়ার সময় মুখ ও মন একসাথেই চলে। কারো কারো বক্তৃতা বা কথা শুনবার সময় মন দিয়েই শুনা হয়। এই যে এখন আমি লিখছি মন দিয়েই লিখছি। মন যা লিখতে বলছে তাই লিখছি। এ সব ব্যাপারে মনোযোগ ঠিকই থাকে। কিন্তু নামায, তসবীহ, যিকরের বেলায় মন বিয়োগ হয়ে যায় কেন?
এটা আমাদের শিক্ষার ত্রুটি। নামাযে যা যা মুখে পড়তে হয় তা শেখাবার সময় মনে কী ভাবতে হবে সে কথা শেখান হয় না। মুখে যা পড়া হয় এর অর্থ জানা থাকা সত্ত্বেও মনোযোগের অভাব হতে পারে ঐ শিক্ষার ত্রুটির কারণে। তেমনি তসবীহ ও যিকরের ব্যাপার। মুখ ও মনকে একই সাথে চলতে হবে। মুখে যা উচ্চারণ করা হচ্ছে মনে এর ভাব জাগরুক থাকতে হবে। নইলে নামায, তসবীহ, ও যিকর প্রাণহীন হয়ে থাকবে। মৃত নামায দ্বারা উপরে বর্ণিত শিক্ষা লাভ হতে পারে না।
মুখে যা উচ্চারণ করা হয় তা মনকে দিয়েও বলাবার পদ্ধতি সম্পর্কে একটু আলোচনা প্রয়োজন। মুখে যা পড়া হয় এর অর্থের দিকে খেয়াল রাখলে মনে অন্য ভাব জাগবার পথ পায়না। কিন্তু এ খেয়াল স্থায়ী রাখা কঠিন। এর জন্য মনের আবেগ যোগ হওয়া বিশেষ জরুরি। রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতের সময় ইহসান এর যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাই আবেগের ভিত্তি। তিনি ইহসানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, এমনভাবে ইবাদত কর যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। যদি এমনটা নাও পার তাহলে অন্ততঃ খেয়াল কর যে, তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন। এ আবেগ সৃষ্টির প্রয়োজনেই নামাযের শুরুতে তাওয়াজ্জুহ (ইনি্ন অজ্জাহাতু… মুশরিকীন ) পড়া হয়। পড়ার সময় মনে এ ভাব জাগ্রত করতে হবে যে, আমার মাবুদ আমার সামনেই হাযির আছেন। সিজদায় মুখে যখন বলা হয় 'সুবহানা রাবি্বয়াল আলা' তখন এর অর্থের দিকে খেয়াল করলে আবেগ সৃষ্টি হবে যে, আমি তো আমার মহান রবের কোলেই আশ্রয় পেলাম। এভাবে নামাযের প্রতিটি অংশে আবেগ যুক্ত হলে মন নামাযের বাইরে ছুটাছুটি করার ফুরসৎই পাবে না।
এমন নামাযই জীবন্ত । জীবন্ত নামাযই মুমিনের জীবনকে গড়বার যোগ্যতা রাখে। শুধু অনুষ্ঠান হিসাবে নামায আদায় করা হলে তা দ্বারা নামাযের কোন উপকারই পাওয়া সম্ভব নয় । অনেকের জীবনে এ কারণেই নামাযের উদ্দেশ্য সফল হতে দেখা যায় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহপাক প্রত্যেক নেক আমলের কমপক্ষে ১০গুণ এবং বেশির পক্ষে ৭০০ গুণ বদলা দেবেন। একই জামায়াতে নামায আদায় করেও কেউ ১০, কেউ ৫০, কেউ ১০০, কেউ ৭০০ পাওয়ার কারণ কী? একই কাজের মজুরী এত বেশ কম করে কেন দেয়া হবে? নামাযে কে কতটা মনকে হাযির রাখতে সক্ষম হলো, কার জযবা ও আবেগ কী পরিমাণ ছিল , কে কতটা মহব্বতের সাথে মনিবের নিকট নিজেকে সমর্পণ করল ইত্যাদির বেশ কমের ভিত্তিতে পুরস্কারের পরিমাণও কম বেশি হবে।
নামায, তসবীহ ও যিকরের ব্যাপারে কমপক্ষে এতটুকু চেষ্টা করতে হবে যে, মুখে যখন উচ্চারণ করা হয়, তখন যেন তা মনের অগোচরে না হয়। মনের দিকে খেয়াল রেখেই মুখে পড়তে হবে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে, বুকের বাম পাশে যেখানে হার্ট বা হৃদপিন্ড থাকে সেদিকে খেয়াল রেখে ধীরে ধীরে মুখে পড়তে থাকলে মনকে নামাযের মধ্যেই আটক রাখা সহজ হয়। এ দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে মনকে নামাযের বাইরে যেতে দেব না। আমার এ অভিজ্ঞার ভিত্তি হলো সুফী সাধকদের 'কালবী যিকর' সম্পর্কে ধারণা । তাঁরা কালবের অবস্থান বুকের বামদিকেই নির্ধারণ করেন । মুখে যেমন আল্লাহ উচ্চারণ করা হয় তেমনি তারা কালবেও তা উচ্চারণ করা অনুশীলন করেন। এমনকি সেখান থেকে এ উচ্চারণের আওয়াজও বের হয়। এটা তো দীর্ঘ অনুশীলনের বিষয়। রাসূল (সা) সাহাবায়ে কেরামকে এ অনুশীলনের শিক্ষা দিয়েছেন বলে আমি এখনও জানতে পারিনি। কিন্তু কালবে উচ্চারণ না করেও কালবের দিকে খেয়াল রেখে মুখে উচ্চারণ করলে যে একাগ্রতা সৃষ্টি হয় এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ খেয়াল যত গভীর হয় মনোযোগ ততই মযবুত হয়। গভীর মনোযোগকেই সুফীগণ মোরাকাবাহ বলেন।
কুচিন্তা ও সুচিন্তা
আগেও বলা হয়েছে যে, দেহের দাবিতে মনে কুচিন্তা জন্মে। কিন্তু বিবেক তা সমর্থন করে না। যারা নৈতিকতার ধার ধারে না তাদের বিবেক দুর্বল। তারা ইচ্ছা করেই কুচিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়। মনের পবিত্রতার কোন মূল্য তাদের কাছে নেই। এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কে এখানে আলোচনা নিষপ্রয়োজন।যারা সুচিন্তা করা পছন্দ করে শয়তান তাদের মনেও সময় সময় মানবীয় দূর্বল মুহুর্তে কুচিন্তা ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু যারা আল্লাহর দাস হিসাবে জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা অবশ্যই কুচিন্তাকে মন থেকে তাড়াবার চেষ্টা করে । কোন সময় যদি ঐ কুচিন্তা মন্দা কাজে লিপ্ত করেই ফেলে তখন তারা অনুতপ্ত হয় এবং তাওবা করে। তারা স্থায়ীভাবে নাফসের নিকট আত্মসমর্পণ করে না।
যারা সুচিন্তায় অভ্যস্ত তাদেরকে নামাযের সময় ইবলিশ নামাযের বাইরের কোন সুচিন্তা মনে ঢুকিয়ে হলেও নামায থেকে অমনোযোগী করে দেবার চেষ্টা করে । তাই নামাযে যে চিন্তা মনে জারী থাকা দরকার তাতেই একাগ্র হতে হবে, নামাযের বাইরের কোন ভাল চিন্তাকেও প্রশ্রয় দেয়া ঠিক নয়। সাধারণতঃ করণীয় বিভিন্ন কাজের ব্যাপারে ভাল চিন্তা এসে নামাযের চিন্তাকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু বাইরের সুচিন্তাকে জীবন্ত নামাযের জন্য ক্ষতিকর। নামাযে শুধু নামাযের চিন্তাই থাকা উচিত।
দুশ্চিন্তা
কোন মানুষই দাবি করে বলতে পারে না যে , তার জীবনে সমস্যা নেই। সম্পূর্ণ রোগহীন দেহ ও সমস্যামুক্ত জীবন অবাস্তব কথা। জীবন আপদ বিপদ ও সমস্যার অন্ত নেই। জীবনের আর এক নামই সমস্যা। জীবন সংগ্রাম মানেই হলো জীবন সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো। সমস্যা আছে এবং থাকবে জেনেই সমাধানের চেষ্টা চালাতে হয়।দুশ্চিন্তা কাকে বলে? দুঃখ দৈন্য, আপদ বিপদ ও দুটনার ফলে যে পরিস্তিতির সৃষ্টি হয় তা থেকে উদ্ধারের পথ পাওয়ার জন্য যে পেরেশানী ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এরই নাম দুশ্চিন্তা। হায় আমার কী হবে? বাঁচার কোন উপায়ই দেখছি না। এর পরিণতি কী? এ জাতীয় চিন্তাকেই দুশ্চিন্তা বলে। দুশ্চিন্তা এমন এক রোগ যে একে প্রশ্রয় দিলে চরম হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। হতাশার চরম পর্যায়ে মানুষ আত্মহত্যা করার মতো চরম দুর্বলতা ও প্রদর্শন করে বসে।
দুশ্চিন্তা সমস্যার সমাধানে সামান্য সাহায্য ও করে না বরং সমস্যাকে আরও জটিল করে । ধীরে চিত্তে ও স্থির মস্তিষ্কে সমাধান তালাশ করতে হয়। অস্থির চিত্ত কখনও সমাধান খুঁজে পায় না। দুশ্চিন্তা চিন্তার ভারসাম্য বিনষ্ট করে বলে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না। এমনকি এ রোগ কোন নির্দিষ্ট পথকেই চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করতে দেয় না। এক একবার এক এক রকম পথ ধরার চেষ্টা হলো চিন্তার বিকৃতি।
আল্লাহতায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাহ দেরকে দুশ্চিন্তার মুসীবত থেকে রক্ষার জন্য এমন কতক মূলনীতির কথা ঘোষণা করেছেন যা মেনে নিলে শত মুসীবতেও মানসিক ভারসাম্য বজায় রেখে চলা সম্ভবঃ
১.আল্লাহর বিনা অনুমতিতে কোন মুসীবত আসে না। যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে আল্লাহ তার কালবকে হেদায়াত দান করেন। (সূরা আত তাগাবুন: ১১ আয়াত)
ব্যাপার এমন নয় যে, কোন বিপদ আল্লাহ ঠেকাতে পারলেন না বলে এসে গেল। বরং আল্লাহ বিপদ দেবার সিদ্ধান্ত করলেই তা আসে। যদি কেউ এ কথা বিশ্বাস করে তাহলে সে অস্থির না হয়ে ধৈর্যধারণ করবে এবং বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহর দরবারেই ধরণা দেবে। আল্লাহর উপর সঠিক আস্থা ও বিশ্বাস থাকলে বিপদের সময় কেমন আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে আল্লাহ সঠিক হেদায়াত দান করেন।
মুসীবত থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করাও কর্তব্য । শান্ত মনে ভেবে-চিন্তে চেষ্টা তদবীর করতে হবে । সঠিক পদ্ধতিতে যাতে তদবীর করা যায় সে জন্য কাতরভাবে দোয়াও করতে হবে। কোন তদবীর ফলপ্রসু না হলেও হতাশ না হয়ে মহান মনিবের নিকটই সঠিক পথ চাইতে হবে।
১.'হে রাসূল আল্লাহ যদি আপনার উপর কোন মুসীবত দেন তাহলে তিনি ছাড়া তা দূর করার ক্ষমতা আর কারো নেই। (সূরা ইউনুস : ১০৭ আয়াত)
যত চেষ্টা তদবীরই করা হোক মুসীবত থেকে উদ্ধার করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে । এ অবস্থায় অস্থির হওয়া, হতাশা প্রকাশ করা বা আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হবার দ্বারা মানসিক যন্ত্রণা পাওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হয় না।
২. 'আল্লাহর উপর ভরসা করাই মুমিনদের কর্তব্য' এ কথাটি বিভিন্ন ভঙ্গিতে বহু সূরায় উল্লেখ করা হয়েছে । আল্লাহতায়ালা তার মুমিন বান্দাদেরকে বার বার তাকিদ দিয়েছেন যে, তোমরা একমাত্র আমার উপর ভরসা কর । জায়েজ পথে চেষ্টা তদবীর অবশ্যই করতে থাক। তবে ঐ তদবীরের উপর আসল ভরসা যেন না হয় । তাহলে হতাশায় ভুগতে বাধ্য হবে।
আসলে আল্লাহর উপর আস্থা রাখাই হলো ভরসা বা তাওয়াক্কুল । মুমিন কোন অবস্থাতেই আল্লাহর উপর আস্থা হারায় না। এ আস্থা রাখতেই হবে যে, আমার মেহেরবান আল্লাহ আমার মঙ্গল করবেন। যদিও আমি বুঝতে পারছি না যে, আমার মুসীবতের মাধ্যমে কী মঙ্গল হতে পারে। তবে এ আস্থা আছে যে, আল্লাহ অমঙ্গল করেন না । বিতরের নামাযে দোয়ায়ে কুনুতে এ অবস্থার কথাই আমরা রোজ ঘোষণা করি এ ভাষায়ঃ
'হে আল্লাহ তোমার উপর ঈমান এনেছি , তোমার উপর ভরসা করেছি এবং তুমি মঙ্গলময় বলেই আমি প্রশংসা করি। অর্থাৎ তুমি যা কিছুই কর তাতে আমার মঙ্গল হবে বলেই বিশ্বাস করি । এ বিশ্বাস ছাড়া হতাশায় যাতনা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। যারা ঈমানদার তারা আল্লাহকে স্মরণ করেই অন্তরে সান্ত্বনা ও প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রাখ একমাত্র আল্লাহর যিকরেই অন্তর সন্ত্বনা লাভ করে।' (সূরা আর রাদ: ২৮ আয়াত)
হাজারো মুসীবতের মধ্যে ও আল্লাহকে ডেকে তার দরবারে ধরণা দিয়ে এবং তার নিকট আশ্রয় চেয়েই মনে শান্তি লাভ করা সম্ভব । সূরা আল ফাতিহায় 'একমাত্র তোমারই দাসত্ব করি এবং একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই' বলার উদ্দেশ্য ও তারই আশ্রয় কামনা করা।
ঈমানদারদের জন্য দুশ্চিন্তা অত্যন্ত মারাত্মক রোগ। কারণ আল্লাহপাক বিপদ মুসীবত সম্পর্ক কুরআনে যে ধারণা দিয়েছেন, তা বিশ্বাস করলে দুশ্চিন্ত থাকার কথা নয় । ঈমানের দাবিদার হয়েও দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয় দিলে ঐ ৪টি মূলনীতিকেই অবিশ্বাস ও অগ্রাহ্য করা হয় । তার দুশ্চিন্তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে,
১. আমার উপর এই মুসীবত দিয়ে আল্লাহ আমার উপর অবিচার করেছেন। এটা করা মোটেই উচিত হয়নি।
২. এ মুসীবত থেকে নিষকৃতি পাওয়ার জন্য আল্লাহর দয়ার অপেক্ষা করার ধৈর্য আমার নেই। আমাকেই কিছু করতে হবে এবং যেমন করেই হোক এ থেকে উদ্ধার পেতে হবে।
৩. এ মুসীবতের মধ্যেও আমার জন্য কোন মঙ্গল থাকতে পারে তা আমি স্বীকার করি না। যারা আমার এ মুসীবতের জন্য দায়ী তাদেরকে আমি ক্ষমা করব না। সুযোগ পেলেই দেখে নেব।
৪. সর্ব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করেই মনে শান্তি পেতে হবে বলে যে কথা বলা হয়, তা কী করে সম্ভব? আমার মনে যাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে তা আমি কেমন করে ভুলব? আর আল্লাহকে এত ডেকেই বা কী হবে? আল্লাহ সাড়া দিচ্ছে না। আর কত ডাকব? এ ভাবে দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয় দিলে ঈমান হারাবারেই আশংকা রয়েছে। তাই দুশ্চিন্তা থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্য আল্লাহর শেখানো নিয়মে মনকে ইতিবাচক কাজ দিন । তাহলে দুশ্চিন্তা মনকে ভারাক্রান্ত করার সুযোগ পাবে না। দুশ্চিন্তা মারাত্মক তৃপ্তির সাথে খেতেও দেয় না। ফলে দৈহিক ও স্নায়ুবিক বিরাট ক্ষতির সাধন করে।
দুশ্চিন্তার ফলে অনেক সময় নিজের উপরই রাগ হয়। মুসীবতের জন্য অন্যদেরকে দায়ী করলে তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এমনকি দুশ্চিন্তা আল্লাহর উপরও অসন্তুষ্ট হতে বাধ্য করে। আল্লাহর প্রতি অভিমান বশে আল্লাহকে নির্দেশ দেয় যে- হয় এটা কর, না হয় ওটা কর । এ সবের কোনটাই সুস্থ মনের পরিচায়ক নয় আল্লাহর উপর পূর্ণ আত্মসমপর্ণই দুশ্চিন্তা থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায়। দুশ্চিন্তার মাধ্যমে শয়তান আপনার উপর রাজত্ব করছে । শয়তানকে উৎখাত করে আল্লাহর রাজত্ব মনের মধ্যে কায়েম করুন । মনে শান্তি পাওয়ার এটাই একমাত্র পথ।
মনের সাথে চোখের সম্পর্ক
মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে চোখকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চোখকে ক্যামেরার লেন্সের সাথে তুলনা করলে মনকে ক্যামেরার ফিল্মের সাথে তুলনা করা যায়। ক্যামেরার লেন্স যা দেখে তাই ভেতরের ফিল্মে ছবি হয়ে যায়। তেমনি চোখের লেন্স দিয়ে যা দেখা হয় তাই মনের ফিল্মে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে । তাই মনকে পবিত্র রাখতে হলে অপবিত্র দৃশ্য দেখা থেকে চোখকে ফিরিয়ে রাখতে হবে।কুরআনে মুমিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পরনারীর উপর চোখ পড়ার সাথে সাথে চোখ নত করতে হবে এবং আবার দেখা থেকে চোখকে ফিরাতে হবে । যেসব মহিলার সাথে বিয়ে জায়েজ নয় তারা ছাড়া অপর মহিলার দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখলে তার ছবি মনে অংকিত হয় এবং সে ছবি মনকে অপবিত্র করতে থাকে। রাস্তা-ঘাটে বা পত্র-পত্রিকায় নৈতিকতার দৃষ্টিতে আপত্তিকর যত রকম দৃশ্য চোখে পড়ে তার প্রতি মনে ঘৃণা জন্মাতে হবে এবং সেসব থেকে সযত্ম্নে চোখকে বাঁচিয়ে চলতে হবে । তাহলে মনে পবিত্রতা রক্ষা করা সহজ হবে।
তসবীহ পড়া বা যিকর করার সময় চোখ বন্ধ রাখলে মনের একাগ্রতা বহাল রাখা সহজে সম্ভব হয়। কারণ চোখ যা দেখে মনকে সে তা দেখায়। নামাযে সব সময় চোখ বুজে থাকা মাকরুহ বলে চোখ বন্ধ রাখার ফাঁকে ফাঁকে চোখ খুলতে হবে। মনকে নামাযে নিবদ্ধ করার প্রয়োজনে চোখ বন্ধ রাখা জায়েয । সব সময় চোখ বুজে নামায আদায় করলে চোখের ট্রেনিং হয় না। নামাযের বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে দেখার বিধান রয়েছে যাতে চোখকেও আল্লাহর হুকুম এবং রাসূলের তরীকা অনুযায়ী ব্যবহার করার ট্রেনিং হয়। এ ট্রেনিং এর উদ্দেশ্য হলো নামাযের বাইরে চোখকে আল্লাহর হুকুম ও রাসুলের তরীকা মেনে চলার যোগ্য বানানো। যাদের নিকট মনের পবিত্রতা রক্ষার ও গুরুত্ব রয়েছে তাদেরকে চোখের নিযেন্ত্রণে অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে।
মনের অবসর সময়ের কাজ
অংগ প্রত্যংগ দিয়ে আপনি যখন কাজ করেন তখন ঐ কাজটি ভালভাবে সমাধা করার জন্য মনোযোগ দিয়েই কাজটি করতে হয়। অবশ্য এটা কাজের ধরনের উপর অনেকটা নির্ভর করে । কৃষক ও শ্রমিকদেরকে শুধু হাত-পা ব্যবহার করে গতানুগতিক ধরনের এমন কাজও করতে হয় যে কাজে মনের তেমন কোন দায়িত্ব থাকে না। রিকশাওয়ালার দেহ রিকশা টেনে নিয়ে যাবার সময় এ কাজে মনের তেমন কোন দায়িত্ব নেই বলে তখন হাজারো ভাব মনে জাগতে পারে।কিন্তু হাত যখন কলম দিয়ে লেখে তখন মন এ কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, মুখ যখন বক্তৃতা করে অথবা কান যখন বক্তৃতা শুনে তখন মন এ কাজেই শরীক থাকে। তাই আপনাকে হিসাব করতে হবে যে, আপনার দেহ যে কাজ করছে সে কাজে মনের দায়িত্ব কতটুকু আছে। যে কাজের সময় মন বেকার থাকে তখন তাকে কাজ দেয়া প্রয়োজন। তা না হলে আপনার অজান্তেই ইবলিশ তাকে বাজে কাজে বেগার খাটাবে। এটাই মানব জীবনের বিরাট এক সমস্যা । মন অত্যন্ত শক্তিশালী যন্ত্র। এর যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা অসীম । কাজ ছাড়া এক মুহুর্তও সে থাকতে পারে না । তাকে সব সময়ই কাজ দেবার যোগ্যতা অনেকেরই নেই। ফলে আপনার এ মূল্যবান কর্মচারী ইবলিশের বেগার খাটে। আপনার দেহ কোথাও বসে বা দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে । ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বা পায়চারী করে কাটাতে হচ্ছে। একা একা পার্কে বা রাস্তায় ভ্রমণ করছেন। যানবাহনের অপেক্ষায় স্টেশনে বসে বা কিউতে দাঁড়িয়ে আছেন। যানবাহনে চুপচাপ বসে আছেন বা বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দৈহিক পরিশ্রম করার পর ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্য বসে বা শুয়ে আছেন, অথবা ঘুমের কামনায় বিছানায় চোখ বুজে পড়ে আছেন। এমন বহু সময় রোজই আমাদের জীবনে কেটে যায় যখন সচেতনভাবে আমরা মনকে কোন বিশেষ চিন্তায়, ভাবনায় বা পরিকল্পনা রচনায় ব্যবহার করি না। মনকে আমরা এভাবে যখনই বেকার রেখে দেই তখন সে ইবলিশের বেগার কর্মচারীতে পরিণত হয়।
এর প্রতিকার হিসাবে রাসূল (সা) একটি ইতিবাচক ও একটি নেতিবাচক উপদেশ দিয়েছেন। নেতিবাচক উপদেশটির সারমর্ম হলো, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর । মনে এমন ভাব আসতে দিওনা যা আল্লাহ অপছন্দ করেন। আল্লাহ মনের গোপন ভাবও জাননে। তাই এ কথা খেয়াল রাখবে যে এমন কথা আমি মনে কী করে স্থান দিতে পারি যা আমার মনিব অপছন্দ করেন ? এভাবে লজ্জাবোধ করলে মনকে বাগে রাখা যায়।
আর ইতিবাচক উপদেশ হলো জিহ্বাকে সব সময় আল্লাহর যিকরে চলমান রাখ। মনে খারাপ ভাব আসতে না দিলে মুখের যিকর মনকে যিকরে মশগুল রাখবে। অর্থাৎ মন ও মুখ কোনটাই খালি রাখা নিরাপদ নয়। মুখের যিকর মনকে যিকর করতে সাহায্য করে। মনকে দেবার মতো কোন কাজ না থাকলে তাকে যিকরে ব্যস্ত করে দিতে হবে এবং এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য মুখে ও যিকর জারী করা দরকার ।
যিকরের ব্যাপারে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । হাদীসে শুধু 'আল্লাহ , আল্লাহ' যিকরের কোথাও শিক্ষা দেয়া হয়নি। আল্লাহ শব্দের সাথে আল্লাহর কোন একটি গুণ থাকা দরকার। যেমন -সুবহানাল্লাহ , আল হামদুলি্লাহ , আল্লাহু আকবার, লা- ইলাহা ইল্লাহ ইত্যাদি। বুখারী শরীফের শেষে একটি চমৎকার তসবীহ শেখানো হয়েছে। রাসূল (সা) বলেন, 'দুটো বাক্য এমন আছে যা মুখে উচ্চারণ করা খুব সহজ, কিন্তু দাঁড়িপাল্লায় বেশ ভারী এবং আল্লাহর নিকট বড় প্রিয়' তাহলো -'সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী সুবাহানাল্লাহিল আযীম।'
কতক বাস্তব পরামর্শ
খালি মনকে ব্যস্ত রাখার আমার ব্যাক্তিগত দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে কতক পরামর্শ পেশ করছিঃ১. সব সময় সব অবস্থায় ইসলামী বই সাথে রাখুন, যখনই মন অবসর হয়ে যায়, ঐ বই পড়ুন। এটা যিকর থেকেও বেশি কার্যকর পন্থা। যিকরে মনোযোগের অভাব হতে পারে। পড়ার সময় তা হয়না। তাছাড়া সকল রকম নফল ইবাদতের মধ্যে দ্বীনের ইলম তালাশ করা শ্রেষ্ঠতম।
২. অনেক সময় বই পড়ার পরিবেশ বা সুযোগ থাকে না। তখন কয়েকটি কাজ করতে পারেনঃ
(ক) কুরআন পাকের মুখস্থ করা সূরাগুলো আওড়াতে থাকুন। পরিবেশ অনুকুল থাকলে গুনগুন করেই পড়ুন।
(খ) কালেমা তাইয়্যেবা, তিন তসবীহ , দরুদ বা যে কোন যিকর মুখে ও মনে জপতে থাকুন।
(গ) আপনার করণীয় কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করার পরিকল্পনা চিন্তা করুন। কারো সাথে আলোচনার কথা থাকলে বিষয়টি মনে মনে গুছিয়ে নিন।
(ঘ) নিঃশ্বাস টানার সময় সচেতনভাবে 'লা-ইলাহা 'এবং নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় 'ইল্লাল্লাহ' নিঃশব্দে মনে মনে পড়তে থাকুন।
(ঙ) একটানা অকেক্ষণ একই ধরনের কাজ করতে মন চায় না। তাই এসব কাজ অদল বদল করে করতে থাকুন।
শেষ কথা
হাদীসে আছে যে, বেহেশতবাসীদের একটি আফসোস ছাড়া বেহেশতে আর কোন মনোবেদনা থাকবে না। দুনিয়াতে যে সময়টা আল্লাহকে ভুলে থেকে কাটিয়ে দেয়া হয়েছে ঐ অবহেলার জন্য আফসোস করতে থাকবে। বেহেশত তো ঐ চিরস্থায়ী বাসস্থানের নাম যেখানে সামান্য দুঃখ-কষ্ট অভাব পর্যন্ত থাকবে না। অথচ একটা বিষয়ে আফসোস থেকেই যাবে। আফসোস তো মনোবেদনারই সৃষ্টি করে। এ দুঃখটুকু থেকেই যাবে। সকলের বেলায় তা হয়তো সত্যি নয় । কিন্তু যাদের বেলায়ই হোক এ বেদনাটুকুর অস্তিত্ব সত্য।এ আফসোসের কারণ তালাশ করলে হাদীসের বিবরণ থেকে তা বুঝা যায় । আল্লাহর দীদারই বেহেশতের সকল নিয়ামতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত বলে বেহেশতবাসীরা মনে করবে। আল্লাহ তায়ালাকে দেখতে পাওয়ার চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কোনটাতেই তারা বোধ করবে না। আর সবাই সমান পরিমাণ সময় আল্লাহকে দেখতে পাবে না। যে দুনিয়ার জীবনে আল্লাহকে যত বেশি স্মরণ করেছে সে তত বেশি সময় আল্লাহকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করবে। তাই যারা কম সময় দেখার সুযোগ পাবে তারাই হয়তো ঐ রকম আফসোস করবে। তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের ভিত্তিতে জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত যারা নেয় তারা মানব সমাজে আল্লাহর প্রভুত্ব ও রাসূলের নেতৃত্ব কায়েমের জন্যই সংগ্রাম করে। আর এ সংগ্রামের পরিণামে আখিরাতে সাফল্যের আশা রাখে। এ সিদ্ধান্ত তাদের মন-মগয চরিত্রকে একবিশেষ ছাঁচে গড়ে তোলে । ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা নাফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়।
যা হোক, আপনি ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় হোন বা না হোন, আখিরাতে মুক্তির কামনা তো নিশ্চয়ই করেন। তাহলে মনটাকে ইতিবাচক কাজ দিন। মনকে ইবলিশের বেগার কর্মচারী হতে দেবেন না। ইবলিশ থেকে মনকে রক্ষা করতে সক্ষম হলে দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য অনিবার্য।
মনে রাখবেন, ইবলিশের বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম মৃতু্য পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। এ সংগ্রাম থেকে বিরাম পাওযার উপায় নেই । তবে দীর্ঘ অনুশীলনের ফলে ধীরে ধীরে আল্লাহর মেহেরবানীতে ইবলিশের পরাজয় হওয়া অসম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেন, 'শয়তান তোমাদের দুশমন, তাকে দুশমনই মনে করবে।' আদম (আ) বেহেশতে শয়তানের ধোঁকায় এ কারণেই পড়েছিলেন যে, তিনি শয়তানকে শত্রু মনে করতে ভুলে গেলেন। (সুরা ফাতের: ৬ আয়াত)
সৌজন্য : ইসলাম.net.bd
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন