১
ছোট একটা পরিবার আর অ্যাকাউন্টেন্টের একটা চাকরী নিয়ে হামিদের দিনকাল ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রত্যেকের জীবনেই কখনো না কখনো কঠিন সময় আসে, হামিদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। অবশ্য এটা যে তার একেবারে নতুন সমস্যা তাও না, ছেলেবেলা থেকেই সে কিছুটা বদমেজাজী বলে পরিচিত ছিল। ইদানীং তার সেই খারাপ চেহারাটা একটু বেশি নিয়মিত দেখা যাচ্ছিল, এই যা।
কিন্তু সে যেদিন মেরে নিজের ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে ফেলল, সেদিন থেকে সবাই বিষয়টাকে একটু আলাদাভাবেই দেখতে শুরু করল। রায়ানের ওপর সেদিন রাগের কারণটা কিন্তু ছিল সামান্য - ছেলেটা তার হিসাবের খাতায় আঁকাআঁকি করে খাতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। সেটায় রেগে গিয়ে হামিদ বাচ্চাটাকে থাপ্পড় দেয় - কিন্তু সে থাপ্পড় এত জোরে ছিল যে রায়ানের মাথা গিয়ে দেয়ালে বাড়ি লাগে। ছোট একটা পরিবার আর অ্যাকাউন্টেন্টের একটা চাকরী নিয়ে হামিদের দিনকাল ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রত্যেকের জীবনেই কখনো না কখনো কঠিন সময় আসে, হামিদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। অবশ্য এটা যে তার একেবারে নতুন সমস্যা তাও না, ছেলেবেলা থেকেই সে কিছুটা বদমেজাজী বলে পরিচিত ছিল। ইদানীং তার সেই খারাপ চেহারাটা একটু বেশি নিয়মিত দেখা যাচ্ছিল, এই যা।
ছেলের রক্ত দেখে সাথে সাথে হামিদের সম্বিৎ ফিরে আসে, রাগ পানি হয়ে যায়। ভয়াবহ একটা আফসোস তখন থেকে তার বুকের ভেতরটাকে জাপটে ধরে থাকে। সে নিজেই বুঝে পায় না, কেন সে এরকম করল। তখন অবশ্য সবাই তাকে মনে করিয়ে দিল যে, সে আজকাল প্রায়ই এরকম ভুল করছে। সেসব শুনে হামিদের হতাশা আরো বেড়ে যায়।
হামিদের মামা মৌলানা ধরণের মানুষ, অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে এক কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলেন। কবিরাজ ভদ্রলোক একজন বৃদ্ধ মানুষ, বয়স প্রায় আশি - কথা বলার সময় বেশ কাশেন। হামিদের মামা জানালেন উনি খুবই আল্লাহওয়ালা লোক এবং মানুষের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে উনি সঠিক মারফতি সমাধান দিতে সক্ষম।
কবিরাজ কিছুক্ষণ দোয়া-দরূদ আর ঝাড়ফুঁক করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন সে কোন ভৌতিক স্বপ্ন দেখে কিনা। ভয়ের স্বপ্ন কে না দেখে! হামিদ বলল যে - হ্যাঁ, সে মাঝেমধ্যে এরকম দু:স্বপ্ন দেখে। তিনি একজন খাদেমের কানে কি যেন বললেন। খাদেম জানাল - উনি বলেছেন হামিদের ওপর জীনের আসর আছে। কবে এবং কোথা থেকে সে জীন তার কাছে এলো সেটাও নাকি কবিরাজ বলে দিয়েছেন - বাইশ বছর সাত মাস সতর দিন আগে খানকান্দি নামে এক গ্রামে এই জীনটা নাকি তাকে নজর দিয়েছিল।
হামিদ অবাক হল - এতো বিস্তারিত বর্ণনা কবিরাজ দিতে পারবেন বলে তার ধারণা ছিল না। ফেরার পথে মামা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, খানকান্দি নামে কোন জায়গায় সে কখনো গিয়েছিল কিনা। হামিদ প্রথমে উত্তর না দেয়াতে মামা তাকে আবারো একই প্রশ্ন করেন। তখন হামিদ বলে যে - হ্যাঁ, ক্লাশ এইটে পড়ার সময় স্কুলের এক বধুর সাথে সে ওই নামে একটা গ্রামে গিয়েছিল, বিয়ে খেতে।
সেটা কি বাইশ বছর আগে? - মামা জানতে চান।
এরকমই হবে - হামিদ অন্যমনস্কভাবে বলে। কিন্তু সে মনে মনে এরমধ্যেই হিসাব করে ফেলেছে - ঠিক বাইশ বছর সাত মাস আগেই সে ওই জায়গাটায় গিয়েছিল।
মামা গম্ভীর হয়ে শুনলেন, হামিদ অবশ্য কিছুতেই স্বীকার করলনা যে এটা জীনের আসর হতে পারে। সে আধুনিক মানুষ, জীন-ভূতে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না - কবিরাজ সাহেবকে নিয়ে সে এককু হাসাহাসিও করল। মামা আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন।
হামিদ অবশ্য তার সমস্যাটির ব্যাপারে নিশ্চেষ্ট বসে থাকল না। সে শহরের একজন নামকরা মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হল। ডক্টর দেবেশ চন্দ্র রয় তাকে সমস্যাটির আগাগোড়া চমৎকারভাবে বুঝিয়ে বললেন।
মানুষের মনের ভেতর দুটি স্তর আছে - বাইরের মন যেটাকে বলা হয় সচেতন মন, আর ভেতরের মন যেটাকে বলা হয় অবচেতন মন। আমরা জেনে-বুঝে যা যা করি, সেসমস্ত কাজের দায়িত্ব সচেতন মনের - যেমন ভদ্রতা করা, হিসাব-নিকাশ, ইত্যাদি। সুতরাং সচেতন মনকে বলা যায় সভ্য মানুষের মন। অন্যদিকে আমরা নিজের অজান্তেই যেসব কাজ করে ফেলি, সেসব কাজের জন্য আমাদের অবচেতন মনকে দায়ী করা যায় - যেমন স্বপ্ন, ভালোবাসা, রাগ, ঘৃণা, ইত্যাদি। অবচেতন মন কোন যুক্তি বোঝে না, এটা শুধু বোঝে নিজের প্রয়োজন। সে অর্থে অবচেতন মনকে মানুষের পাশবিক স্বত্ত্বাও বলা যায়। আপনার ক্ষেত্রে সমস্যাটি যেহেতু রাগ, এটা অবচেতন মনের এলাকায় পড়ে - আর এজন্য আমাদের কাজ করতে হবে আপনার অবচেতন মনকে নিয়েই।
হামিদ কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। এখন পর্যন্ত ভদ্রলোকের কথাগুলো তার কাছে সহজবোধ্যই মনে হয়েছে।
আপনার অবচেতন মন নিয়ে কাজ করার জন্য আমরা যে পদ্ধতিটা অনুসরণ করব, সেটা হচ্ছে সম্মোহন - হিপনোসিস। আমরা আপনার সচেতন মনের দরজা-জানালাগুলো কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেব যাতে করে আপনি অবচেতন মনের ভেতর ঢোকার পথটা খুঁজে পান।
মনের দরজা-জানলা মানে কি?
আপনার মনকে একটা ঘরের সাথে তুলনা করেছি আমি। কাজের জন্য এটা বেশ সুবিধাজনক - এক্ষেত্রে আপনার সচেতন মনটাকে বলা যায় বাইরের ঘর, আর অবচেতন মনটা মাটির নিচের লুকানো একটা ঘর। লুকানো ঘরটা কিন্তু বাইরের ঘরের চেয়ে অনেক বড়, আর এর কর্মকান্ডও বেশ জটিল।
তাহলে আমি কিভাবে ... - হামিদ বলতে গেল।
ভদ্রলোক হামিদকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন - সেটার জন্য তো আমরা আছিই, তাই না? তো যেটা বলছিলাম, আপনার সচেতন মনের সব দরজা-জানলা আমরা বন্ধ করে দেব প্রথমেই। সচেতন মনের দরজা-জানলা কোনগুলো? দরজা-জানলা মানে হচ্ছে ইন্দ্রিয়গুলো - মানুষের পঞ্চইন্দ্রিয়। তবে প্রধাণত চোখ আর কানের মাধ্যমেই আমাদের মন বাইরের জগতের তথ্যগুলো পেয়ে থাকে। আমরা মোটামুটি শব্দহীন একটা রুমে একদম অল্প আলোয় আপনার সাথে কিছু সেশন করব। আপনার মন বাইরের হট্টগোল থেকে থাকবে একদম মুক্ত। তখন আপনি নিজের ভেতরের দিকে তাকানোর সুযোগ পাবেন।
আপনাকে পর পর কয়েকটা সেশন আমাদের সাথে কাজ করতে হবে। আপনি সামনের ডেস্কে কথা বলুন, ওরা আপনাকে সুবিধামত অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিডিউল করে দেবে।
হামিদ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে চেম্বার থেকে বের হয়ে এল - ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে তার ভালো লেগেছে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানে সে সেশনগুলো করবে।
এরমধ্যে একদিন মামা এলেন হামিদের বাসায়। সেই বৃদ্ধ কবিরাজ নাকি তার কথা জানতে চেয়েছে মামার কাছে। হামিদ বলল, সে ডাক্তার দেখাচ্ছে।
ডাক্তার দেখাও, বাবা। কিন্তু পাশাপাশি এই চিকিৎসাটাও কর, এতে ক্ষতির কিছু নেই।
হামিদ হাসল।
জানি, তুমি এগুলি মানতে চাও না। কিন্তু এগুলি আছে, আর উনি সেটা জানতে পেরেছেন। শোনো, তোমার ওপর যে নজরটা পড়েছে সেটা খুব খারাপ ধরণের। খারাপ না হলে উনি আলাদা করে তোমার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন না - কত লোক আসে উনার কাছে। তুমি এটা অবহেলা কোরো না।
হামিদ মাথা নাড়ল।
আমি এই দোয়াটা এনেছি। তুমি এটা সবসময় তোমার কাছে রাখবে। এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বুঝলে বাবা?
হামিদ কাগজটা নিল, তারপর মানিব্যাগে সেটা ভরে রাখল। মামা চলে গেলেন।
হামিদ আগে থেকে ঠিক করা শিডিউল অনুযায়ী রয় সাহেবের চেম্বারে গেল। ভদ্রলোক হাসিমুখে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন, তার বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলেন। শেষে জিজ্ঞেস করলেন সে প্রস্তুত কিনা। হামিদের সম্মতি জানার পর উনি তাকে ভেতরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন।
ভেতরের এই ঘরটা একটু অন্যরকম, ঠিক ডাক্তারের চেম্বারের মত সেটিং নয় এখানে। পাশে নীলচে শেডের একটা ল্যাম্প জ্বলছে, সারা ঘরের আলোর একমাত্র উৎস এটাই - ফলে ঘরে আলো খুব অল্প। ঘরটায় শব্দ খুবই কম - সম্ভবত ভেতরের দিকের ঘর এটা, অথবা দরজা-জানালা বন্ধ রেখে শব্দ কম রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঘরের মাঝখানে একটা ইজিচেয়ার। পাশে একটা সিঙ্গেল সোফা। রয় সাহেব ইঙ্গিত করতেই সে ইজিচেয়ারে গিয়ে বসল। রয় বসলেন পাশের সোফাটায়।
যেভাবে আরাম পান সেভাবে হেলান দিয়ে বসুন। হ্যাঁ, কমফোর্ট ফিল করলেই হবে। নিজের মনের ওপর চাপ দেবেন না, হালকা ভাবে নিন সময়টা। ভুলে যান না পৃথিবীর কথা - যা হবার তা তো হবেই, আমরা তার কতটুকুই বা বদলে ফেলতে পারব। সুতরাং নিজেকে দশ-পনর মিনিট সময় দিই, তাতে পৃথিবীতে আমাদের ভূমিকা আমরা আরো ভালো করে পালন করতে পারব। তাই না?
উনার কণ্ঠ নরম হয়ে আসছিল।
ওকে, ফাইন, এখন ছাদের দিকে তাকান, হ্যাঁ, দেখুন একটা পয়েন্ট আছে - সিলিং ফ্যান ঝুলানোর পয়েন্ট। পেয়েছেন? হ্যাঁ, ওটার দিকে তাকিয়ে থাকুন, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুন। গুড, এখন আমার কথা শুনুন। শুধু আমার কথা শুনুন। শুনতে থাকুন . . . . .
ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে।
তন্দ্রা, তন্দ্রা, তন্দ্রা, আপনার তন্দ্রা এসে যাচ্ছে। তন্দ্রা, তন্দ্রা, তন্দ্রা . . . . .
উনি বলতেই থাকলেন। এ পর্যায়ে ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর নামতে নামতে প্রায় খাদে নেমে এলো। এদিকে সত্যি সত্যিই হামিদের চোখের পাতা দুটো যেন ভারী হয়ে আসছিল।
একসময় হামিদের চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তখন রয় সাহেব প্রথমে শিথিলায়ন নামে একটি প্রক্রিয়ায় হামিদের তার পুরো শরীরটাকে ভারমুক্ত করে দিলেন, হামিদ অসাধারণ একটা শান্তি অনুভব করল পুরো শরীর জুড়ে। পুরো শরীরে এধরণের আরামদায়ক শৈথিল্যের অনুভূতি তার জীবনে এটাই প্রথম।
পুরো শরীর শিথিল হয়ে যাবার পর রয় মূল বিষয়ের অবতারণা করলেন - এখন একটা ঘর কল্পনা করুন, শূণ্য ঘর। এ পৃথিবীতে আছেন শুধু আপনি, আর আপনার এই ঘর। এটাই আপনার মনের ঘর। কল্পনা করতে পেরেছেন? পারলে আপনার ডান হাতটা অল্প নাড়ান। চেষ্টা করতে থাকুন . . . কল্পণা করতে . . .
বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর হামিদ যখন সেটা কল্পণা করতে পারল, সে হাত তুলে রয় সাহেবকে ইঙ্গিতে জানাল সেটা।
গুড - রয় বললেন - আপনার মনের ঘরে আপনি স্বাধীন, ঘুরে বেড়ান এপাশ থেকে ওপাশে। দেখুন চারিদিক। কি সুন্দর ! কি শান্তি !
হামিদ তার মনের ঘর দেখে সত্যিই খুব শান্তি অনুভব করল।
ঘরের ডানপাশে একটা দরজা আছে।
হামিদ কল্পনার ভেতরই ডানদিকে তাকাল - সত্যিই তো একটা দরজা আছে এ পাশে !
দরজা খুললেই দেখতে পাবেন, বরাবর একটা সিড়ি নেমে গেছে নিচে। নিচে অন্ধকার, কিন্তু সিড়ির ওপরের ধাপগুলো দেখা যাচ্ছে।
দরজা খুলে হামিদ সত্যি সত্যিই সিড়ি দেখতে পেল - সিড়িটা নিচে নেমে গেছে, অন্ধকার একটা ঘরে।
নিচের ঘরটা অন্ধকার, কারণ ওটা আপনার অবচেতন মন। মনের এই ঘরের কাজকর্ম ঘটে আপনার অজান্তে . . . . . . ওই ঘরে কি হচ্ছে জানতে চান? তাহলে সিড়ি গুনে গুনে নেমে যান। চলুন না, ঘুরে আসি সেই ঘরে। আচ্ছা, চার্জার লাইটটা নিয়ে যাবেন সাথে করে, কারণ ও ঘরটা চির অন্ধকার।
হামিদ অনুভব করল, তার হাতে একটা চার্জার লাইট ধরা। রয় সাহেব যা যা বলছেন, তাই সত্য হয়ে যাচ্ছে। সম্মোাহিত মানুষের বোধ হয় এরকমই হয় !
কিন্তু সে তখন এসব নিয়ে চিন্তিত নয়। সে তীব্র কৌতূহল নিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকল নিচের সে রহস্যময় ঘরটায়।
আপনি প্রথম সিড়িটা পার হলেন . . . . . দ্বিতীয়টা . . . . . তিন নম্বর . . . . . . . চার . . . . . . . . পাঁচ . . . . - এভাবে দশ পর্যন্ত গুনতে গুনতে হামিদ দেখল সে আসলেও নতুন একটা ঘরে চলে এসেছে। এ ঘরটা ওপরের ঘরটার মতই, কিন্তু চার্জার লাইটের আলোয় সে দেখল এ ঘরের দেয়ালের রংটা গোলাপী।
পকেট থেকে চকটা বের করুন। পেয়েছেন? গুড। এখন সামনের দেয়ালে লিখুন - রাগ। লিখেছেন? এখন ভালো করে পড়–ন শব্দটা - রাগ। পড়েছেন? ভালো। এবার সেই রাগ শব্দটার ওপর ক্রশ চিহ্ন দিন . . . ক্রশ চিহ্ন দিন। দিয়েছেন? আপনার কাজ শেষ, দ্রুত চলে আসুন ওপরের ঘরে . . . ওপরের ঘরে . . . সিড়ি . . . সিড়ি বেয়ে উঠুন . . . দশ . . . নয় . . . আট . . . - এভাবে এক পর্যন্ত পৌঁছে তিনি বললেন - এবার চোখ খুলুন।
হামিদ চোখ খুলল - সে রয়ের চেম্বারের সেই আধো-অন্ধকার ঘরটায় বসে আছে।
উঠে পড়–ন, আপনি তো বেশ সুন্দর সহযোগিতা করেছেন - রয় সাহেব খুব সুন্দর করে হাসলেন।
আশ্চর্য সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা - হামিদ ভাবল।
কেমন লাগল, নিজের মনের ঘর দেখতে ?
ভালো, খুব ভালো - হামিদ এমনভাবে বলল, যেন এখনো সম্মোহনের ভেতরই আছে।
আপনার সমস্যাতো অর্ধেকটাই সমাধান হয়ে গেছে মনে হচ্ছে - ভদ্রলোককে খুব আনন্দিত মনে হল।
তাই? - হামিদ ঘোলাটে চোখে উনার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ, তাই। আচ্ছা, অবচেতন মনটা দেখতে কেমন লাগল? কেমন যেন রহস্যময়, তাই না? - উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন রয়।
হামিদ মাথা নাড়ল, তারপর কি মনে হতেই তাড়াতাড়ি বলল - আচ্ছা, অবচেতন মনের ভেতর আমি যেন একটা ছায়া দেখলাম। এটা কি, ডাক্তার সাহেব?
ছায়া?
হ্যাঁ, যেন অন্য কেউ আছে ওখানে, আমি বাদে অন্য কেউ?
রয় ভ্রুকুঞ্চিত করলেন - এরকম তো হবার কথা না।
মানে? এরকম হবার কথা না কেন?
কারণ - রয় বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন - আপনার মনের অবচেতনে আপনি ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই, এমনকি জাগ্রত অবস্থায় আপনার নিজেরও সেখানে প্রবেশ করার শক্তি থাকে না।
তাহলে ছায়াটা কার?
রয় চুপ করে কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন - আপনি ঠিক কি দেখেছেন সেটা জানতে হবে, অবচেতন মন রহস্যময় জায়গা তো, খুব ভালোভাবে না জেনে কিছু বলা সম্ভব না।
হামিদ চুপচাপ কথাটা শুনল।
যা হোক, চলুন উঠি, আমার অনেক সময় নিয়ে নিয়েছেন আপনি। বাসায় যাবো না? - রয় অমায়িক হেসে বললেন।
হামিদ উঠে দাঁড়াল - সম্মোহনের ঘোর যেন তার পুরোপুরি কাটেনি তখনো।
ঠিক একমাস পর আবার দেখা করবেন। আজকে চলে যান। আশা করি হাতে হাতেই ফল পাবেন।
হামিদ সেদিনের মত চলে এলো, কিন্তু তার মনে আশ্চর্য এক স্বপ্নের মত জেগে রইল সে সন্ধ্যার কথা।
এরপর দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ চলে গেছে। হামিদ এরমধ্যে মজার একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে - যখনই কোন কারণে তার রাগ ওঠে, তখনই কোথা থেকে চোখের সামনে একটা ক্রশচিহ্ন ভেসে ওঠে, আর ওমনি তার রাগ পানি হয়ে যায়।
একদিন পাঁচশ টাকার একটা নোটের ভাংতি চাইতেই এক দোকানদার তার সাথে খুব বাজে একটা প্রতিক্রিয়া দেখাল। অন্য কোন সময় হলে তার মাথায় রক্ত উঠে যেত - সেদিন সে শান্তভাবে লোকটাকে শুধু বলল, এত কথা না বলে শুধু বলবেন - ভাংতি নেই, এতে আপনারই কষ্ট কম হবে। নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ দেখে সে নিজেই অবাক হল।
এরমধ্যে আরেকদিন মামার সাথে তার দেখা হল। উনি জানতে চাইলেন, সে দোয়ার কাগজটা ঠিকমত রেখেছে কিনা। হামিদ বলল - হ্যাঁ, সেটা সে সাথেই রেখেছে। মামা তাকে বললেন, তার ওপর খুব খারাপ একটা নজর আছে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে, সে যেন কাগজটা খুব সাবধানে রাখে। কিন্তু মামা চলে যাবার পরে হামিদ মানিব্যাগ ঘেটে দেখল, দোয়ার কাগজটা সেখানে নেই - সম্ভবত কখনো সেটা কোথাও পড়ে গেছে। তবে হামিদকে সেটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত মনে হল না - সে সম্মোহন চিকিৎসার ভেতরই তার সমস্যাটার সমাধান পেয়ে গেছে। ফলে মামার কথা আর দোয়া পড়া কাগজের ব্যাপারটা সে একসময় ভুলেই গেল।
দ্বিতীয়বার হামিদ যখন রয়ের কাছে গেল, রয় তাকে একইভাবে সম্মোহিত করলেন। সম্মোহনের মাধ্যমে সে তার অবচেতন মনের ঘরে ঢুকল, তখন রয় তাকে সাজেশন দিলেন যে রাগের সময় সে শান্ত থাকবে। তারপর যথানিয়মে হামিদকে তিনি বের করে আনলেন মোহাবস্থা থেকে। হামিদ একসময় সম্মোহন থেকে জেগে উঠল বাস্তবতায়।
এভাবে আপনাকে নিয়মিত করতে হবে, যেন আপনার অবচেতনে সাজেশনটা স্থায়ী হয়ে যায়, বুঝলেন - রয় হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকালেন।
কিন্তু হামিদকে একটু অন্যমনস্ক মনে হল। সে চিন্তিত মুখে বলল - আজও দেখেছি।
কি দেখেছেন আজও?
ছায়া, আজকে মনে হয় ছায়ার মালিককেও দেখলাম - হামিদ বলে।
ছায়ার মালিক মানে?
সেদিন যার ছায়া দেখেছিলাম অবচেতন মনের ঘরটায়। এটা একটা মেয়ের ছায়া।
ইন্টারেস্টিং - রয় তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন - এরকম তো শুনিনি কখনো। আপনার পরিচিত কারো সাথে মিল আছে তার চেহারার? আপনার অতীত জীবনের কোন প্রেম?
না, আমি নিশ্চিত ডাক্তার সাহেব, এ চেহারা আমি কোনদিন কোথাও দেখিনি। অসম্ভব রূপসী মেয়েটা।
রয় একটা দীর্ঘনি:শ্বাস ফেললেন - সম্ভবত আপনার উইশফুল থিংকিং এটা, স্বপ্নের রাজকন্যা। তবে আপনাকে ফ্র্যাংলি বলি, হিপনোটিক সাজেশনের সময় এরকম কোন স্বতন্ত্র এনকাউন্টারের কথা এই প্রথম শুনলাম আমি। এটা হবার কথাও নয় - কারণ হিপনোটিক সাজেশন দেবার সময় পেশেন্ট থাকে পুরোপুরি ডাক্তারের নিয়ন্ত্রণে, ডাক্তার যা বলে তাই তার কাছে সত্য বলে মনে হয়, অন্যকিছুর কথা সে তখন ভাবতে পারে না - পারলে সাজেশন দেয়া সম্ভব হতোনা, আর মনও সে সাজেশন নিত না।
রয় চুপ করে বসে কি যেন ভাবছিলেন, হামিদ তাকে বিদায় জানিয়ে চলে এল।
পরবর্তী মাসে হামিদ চিকিৎসার ফল আরো ভালোভাবে অনুভব করল। সে লক্ষ্য করল - শুধু তার রাগ কমে গেছে তাই না, সে উত্তেজিতও হচ্ছে খুব কম। সম্ভবত মানসিক অনুশীলনটা তার মনের স্বাস্থ্যের ক্রমাগত উন্নতি ঘটাচ্ছে, ফলে সব ক্ষেত্রেই তার ভালো প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এরমধ্যে একদিন হামিদের মামা তাকে ফোন দিলেন, বললেন সাবধানে থাকতে - তাকে নিয়ে নাকি খুব খারাপ একটা কি স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটার বর্ণনা অবশ্য তিনি তাকে দেননি, খারাপ স্বপ্নের কথা নাকি আলোচনা করতে হয় না।
তৃতীয় মাসে রয় সাহেবের চেম্বারে যখন হামিদ উপস্থিত হল হিপনোটিক সাজেশন নেবার জন্য, রয় তাকে বললেন যে - চিকিৎসায় খুব ভালো ফল দেখা যাচ্ছে, হামিদের ব্যাপারটা খুব আশাব্যঞ্জক। হামিদও মনে মনে মানল কথাটা - সে নিজেওতো কার্যক্ষেত্রে প্রমাণ পেয়েছে যে নিজের মনের ওপর তার বেশ ভালো নিয়ন্ত্রণ এসে গেছে। রয় আরো জানালেন যে - যত দিন যাবে তত তাকে সম্মোহিত করতে আরো কম সময় লাগবে। একসময় সে নিজেই নাকি নিজেকে সাজেশন দিতে পারবে। এটার নাম আত্মসম্মোহন, এটা রয় তাকে শিখিয়ে দেবেন বলে কথাও দিলেন - তখন তাকে আর সেশনের জন্য রয়ের কাছে আসতে হবে না, অবসর সময়ে নিজেই নিজেকে সম্মোহন করতে পারবে সে।
সেদিনও যথারীতি ওরা সেই রুমে গেল, তারপর হামিদ একদৃষ্টিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকল, একসময় তার চোখের পাতা ভারী হয়ে এল, সে তারপর চলে গেল মোহাচ্ছন্ন একটা অবস্থায়। সে অবস্থায় সে তার মনের ঘরে ঢুকল, ঢুকে ডানদিকে দরজা দেখল। সে দরজা খুলে সিড়ি বেয়ে সহজেই নেমে গেল মাটির নিচের ঘরটায়, অর্থাৎ তার অবচেতন মনে। হাতের চার্জার লাইট দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল ঘরের বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে সেই দেয়ালটা যেখানে রাগ কথাটা লিখে তার ওপর ক্রশচিহ্ন দিয়েছিল সে নিজে। সে দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সম্মোহনের ব্যাপারটায়, ফলে এসব ঘটল খুব সহজে আর খুব দ্রুত। সবশেষে সে ঘরের মাঝখানে গিয়ে বসল, সেখানে সে অপেক্ষা করতে থাকল রয়ের সাজেশনের জন্য।
ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। সে মেয়েটাকে আবার দেখতে পেল - অনিন্দ্যসুন্দরী একটা মেয়ে। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে হাসল - নি:শব্দ হাসি। মেয়েটাকে তার কাছে পরীর মত সুন্দর মনে হল, খুব পরিচিতও মনে হল - ফলে সেও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল।
এরমধ্যে সে শুনতে পেল রয়ের কণ্ঠস্বর - উত্তেজনার সময় শান্ত থাকব, আকাশের মত শান্ত।
তখন মেয়েটা তাকে কাছে ডাকল, সে সম্মোহিতের মত এগিয়ে গেল। মেয়েটা দেয়ালে কি যেন লিখছে। রয়ের কণ্ঠস্বর তখনও দুর্বলভাবে তার কানে আসছে - যেন ওপর তলায় বসে রয় তাকে কথাগুলো বলছেন, আর এখানে সে শব্দগুলো ঠিকমত পৌছাচ্ছে না।
হামিদ দেয়ালের লেখাটা পড়তে শুরু করল, যেটা সেই মেয়েটা এইমাত্র লিখেছে ওর জন্য - আমাকে তুমি সারাজীবন ভালোবাসবে, তুমি আমার সাথে থাকবে চিরদিন।
লেখাটা পড়ে কেন যেন খুব ভালো লাগলো হামিদের - উত্তেজনাভরা একটা আনন্দ।
মেয়েটা তার হাত স্পর্শ করল, হামিদের তখন ভীষণ ভালো লাগল। অসাধারণ একটা অনুভূতি। মেয়েটা এবার ওকে টেনে নিয়ে চলল। হামিদ দেখল, মেয়েটা তাকে নিয়ে যাচ্ছে প্রথমে সিড়িটার দিকে - যে সিড়ি দিয়ে সে এঘরে নেমে এসেছে। তারপরই ওরা সিড়ি বেয়ে উঠে গেল দরজাটার দিকে - যে দরজা খুলে হামিদ এ ঘরে ঢুকেছিল।
মেয়েটা ওর হাতে একটা তালা এগিয়ে দিল। তারপর একবার ইংগিত করল দরজাটার দিকে, আরেকবার দেয়ালের লেখাটার দিকে। মেয়েটা তখন সুন্দর করে একটা চুমু একে দিল হামিদের ঠোঁটে। রয়ের কণ্ঠ হামিদ তখন বলতে গেলে শুনতেই পাচ্ছে না।
হামিদ দরজাটা বন্ধ করে দিলো - এপাশ থেকে, তারপর তালাটা লাগিয়ে দিল সেটায়।
২
রয় আবারো ডাকলেন - হামিদ, আপনি এখন জেগে উঠবেন।
কিন্তু এবারো কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না হামিদের মধ্যে। রয় কপালের ঘাম মুছলেন - এরকম ঘটনা তার চিকিৎসক জীবনে আর কেনদিন ঘটেনি, অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটেছে বলেও তার জানা নেই।
রয় আবার চেষ্টা শুরু করলেন। প্রায় আধঘন্টা ডাকাডাকির পর হামিদের চোখ খুলল। রয় হেসে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন - অবশ্য সাথে সাথে এও লক্ষ্য করলেন, হামিদের চোখ ভীষণ লাল হয়ে আছে - জ্বরগ্রস্থ মানুষের চোখের মত লাল।
হামিদ, আপনার এখন কেমন লাগছে? - রয় দুর্বলভাবে প্রশ্ন করলেন।
হামিদ? - অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল - হামিদটা আবার কে?
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন