আমার আনন্দ আর বেদনার এই দিনটি, একদিন আগুপিছু হলে মহাকালের দিন বিন্যাসে কি এমন সমস্যা হত? এ দু’য়ে কি শুধুমাত্র আমার বেলায় এক হয়েছে? নাকি এমন অহরহই ঘটে থাকে, কেউ জানে কেউ জানে না।
বারান্দায় বসে দ্বৈত অনুভূতির এক দমবন্ধ সময় পার করছি একাকী। রাত গভীর। আকাশের পেয়ালা ভর্তি লক্ষ কোটি নক্ষত্র। প্রকৃতি দীঘির জলের মত স্থির। চারিদিক বড় নির্জন-নিশ্চুপ। নৈশব্দেরও বুঝি শব্দ থাকে, নির্বাক প্রকৃতিরও না বলা কথা থাকে। তেমনি যেন দূরে কোথাও গুমরে গুমরে সরোদ কেঁদে চলেছে একটানা। শোনা যায় না, উপলব্ধি করা যায়। বাসায় একমাত্র জেগে আমি। সারাদিন রান্না বান্নায় ব্যস্ত সময় কেটেছে। বিকেলে এতিমখানার কিছূ ছেলেপুলে খাইয়েছিলাম। আর রাতে কয়েকজন ভিক্ষুক-মিসকিন-আত্মীয়স্বজন। খাটুনি গেছে বেশ। এখন খুবই ক্লান্ত। কিন্তু ঘুমের যেন আড়ি হয়েছে চোখের সাথে।
পাঁচ বছর আগের এইদিনে আমার বাবা চোখ বুঁজেছিল। আবার তার এক বছর পর একইদিনে সে আমার কোলে ফিরে এসেছিল। ভেবে ভেবে আকুল হই। মনের কোণে প্রশ্ন জাগে; চূড়ান্ত কোন্ লক্ষ্য নিয়ে নানা রঙ্গের অংক কষে বিধাতা তার খেলায় মাতে?
খেলায় খেলায় কষ্ট বাড়ে, কষ্ট কমে অন্তরালে। আমার যে কোনটা হয় নিজেই তো বুঝিনা ছাই।
রাত এগারটায় সমস্ত আয়োজন শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন রান্না ঘরের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি, তখন ড্রইং রুম থেকে কিছু একটি ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাই। কিছুক্ষণ পর রান্না ঘরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে তুষার বলল, ‘মা, লোবত তা ভেংগে গেতে।’ শুনে আমার আনন্দ আর ধরে না। আনন্দটা কিসের বুঝতে পারি, বোঝাতে পারি না।
আজ তুষারের চতুর্থ জন্মদিন গেল। চতুর্থ সুখবার্ষিকী। সেই সাথে আমার পঞ্চম বেদনাবার্ষিকীও বটে। ছেলেটার বয়সের তুলনায় কথা একটু দেরীতে ফুটছে। ডাক্তার বলেছেন, ‘সমস্যা নাই, অনেক শিশুই দেরীতে কথা বলে।’ অনুষ্ঠানটি ছোটখাট করে করব করব করেও মোটামুটি বড় হয়ে গেল।
আমার বিয়ের আট বছর পর, বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন তুষার জন্মেছিল। বড় আশার এ জন্মদিনটি স্বামী সন্তানের সাথে উপভোগ করতে পারি না কখনোই। সুখের এই দিনটিতে যে কষ্টে কষ্টে লীন হয়ে যাই আমি।
বাসায় যে প্রৌঢ়া মহিলাটি আমাকে সারাদিন সাংসারিক কাজে সহযোগীতা করে, সে কিভাবে যেন জেনেছে আজ তুষারের জন্মদিন। যদিও ব্যাপারটি আমি গোপন রেখেছিলাম। সম্ভবত সেজন্যেই সে আজ একটি খেলনা মানুষ নিয়ে এসেছে। ছেলের বাবাও ছেলের জন্যে উপহার একটি এনেছিল গতকাল, সাইকেল। কিন্তু সাইকেল ফেলে এই সস্তা দামের রোবটটি কেন যে তার এত পছন্দ হয়ে গেল সে ই জানে। খুশী’র মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি আবার এটা আনতে গেলে কেন?’ সে ঠোঁট দু’টো অল্প নেড়ে বলেছিল, ‘আনলাম, পোলাপান মানুষ!’
শুনেছি বাবা শত কষ্টের মাঝেও আমার প্রথম জন্মদিনটির আয়োজন করেছিল। পরের জন্মদিন গুলোতে কেক কাটার মত আর্থিক সংগতি তার ছিল না। তাই বাকী জন্মদিনগুলো স্মরণ করা হলেও পালন করা হয়নি আর। সেই প্রথম জন্মদিনে তার দেয়া কাঠের পুতুলটি অক্ষত আছে আজো। এত আগের খেলনাটি এখনো অটুট থাকাতে আমার ভেতর আনন্দ জাগে না মোটেও। কষ্ট হয়। বাবাও যে ওটি দেখলে কষ্ট পেত তা বড় হয়ে বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।
আমাদের টিভি রুমে দাদার সচ্ছলতার শেষ প্রতীক হিসেবে একটি কারুকাজ করা বিশালাকৃতির শোকেস ছিল। তার নীচের দিক হতে ফুট তিনেক উপরে তাকের মত একটি বড়সড় খালি জায়গা ছিল। বাবা ওই খালি জায়গাটিতে আমাদের টিভিটা বসিয়েছিল। তবে এত বড় জায়গায় বার ইঞ্চি টিভিটাকে বড্ড বেমানান দেখাত। টেলিভিশন দেখতে বসলেই শোকেসে রাখা পুতুলটির দিকে বাবা আর আমার চোখগুলো ছুটে যেত বারবার। বাবা পরে টিভি সেটটি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছিল। বাবার কষ্টের পেছনের কারণ হচ্ছেন আমার মা।
মা খুব কড়া ধরনের মহিলা ছিলেন। এখানে যেতে পারবে ওখানে যেতে পারবে না, এটা খেতে পারবে ওটা খেতে পারবে না, চারপাশে সারি সারি নিয়ম কানুনের বেড়া। এরকম অনেক অনেক বিধি নিষেধের হাত থেকে সেই খেলনাটিও রেহাই পায়নি শেষ পর্যন্ত। সংসারের সবকিছুর প্রতিই মা বিশেষভাবে যত্নশীল ছিলেন। তেমনি খেলনাটির প্রতিও। সদা সতর্ক। তাই জন্যে, পুতুলটিকে মলিন বৈঠকখানার শোভা বর্ধনে শোকেসের গরাদে বন্দীত্ব বরণ করতে হয়েছিল কাঁচা বয়সেই। কখনো সখনো মায়ের অবর্তমানে বাবা পুতুলটি বার করে আমাকে সাথে নিয়ে খেলত। তবে সাবধানে থাকতে হত, যাতে পুতুলের গায়ে আঁচড় না লেগে যায়।
সেটি এখনো সযতনে রাখা আছে নীল মখমলে মুড়ে। তুষারের বাবাও অনেকটা আমার মায়ের মতই। সে একদিন ছেলেকে বলছিল, ‘আর কিচ্ছু আনব না কক্ষনো। বিকালে এত সুন্দর প্লেন আনলাম, রাতেই ভেঙ্গে ফেললি!’
কোন্ ভাঙ্গাতে তুষ্টি জাগে বুঝতে পারা ভার। খেলতে গিয়ে খেলনা ভাঙ্গা, নাকি না খেলাতে হৃদয় ভাঙ্গা? কে কিসেতে আনন্দ পায়, কান্না আসে কার?
এই মাঝরাতে নিজের কাছে নিজেকেই চোর চোর মনে হচ্ছিল। সন্তর্পনে আলমারী খুলে পুতুলটি বার করে বারান্দায় ফিরে আসি। প্রতি বছর এই বিশেষ দিনের এই সময়ে পুতুলটির সাথে আমি একা একা খেলি। স্বামী পুত্র কেউ জানে না এ খেলাটির মর্মকথা, শুধু জানি আমি। আর জানে সে, যে কিনা খেলেই চলে - খেলেই চলে, জীবন্ত সব খেলনা নিয়ে। ভাঙ্গা গড়ার খেলায় মেতে খুঁজতে থাকে - খুঁজতে থাকে; তার সৃষ্টির সার্থকতা।
বারান্দায় বসে দ্বৈত অনুভূতির এক দমবন্ধ সময় পার করছি একাকী। রাত গভীর। আকাশের পেয়ালা ভর্তি লক্ষ কোটি নক্ষত্র। প্রকৃতি দীঘির জলের মত স্থির। চারিদিক বড় নির্জন-নিশ্চুপ। নৈশব্দেরও বুঝি শব্দ থাকে, নির্বাক প্রকৃতিরও না বলা কথা থাকে। তেমনি যেন দূরে কোথাও গুমরে গুমরে সরোদ কেঁদে চলেছে একটানা। শোনা যায় না, উপলব্ধি করা যায়। বাসায় একমাত্র জেগে আমি। সারাদিন রান্না বান্নায় ব্যস্ত সময় কেটেছে। বিকেলে এতিমখানার কিছূ ছেলেপুলে খাইয়েছিলাম। আর রাতে কয়েকজন ভিক্ষুক-মিসকিন-আত্মীয়স্বজন। খাটুনি গেছে বেশ। এখন খুবই ক্লান্ত। কিন্তু ঘুমের যেন আড়ি হয়েছে চোখের সাথে।
পাঁচ বছর আগের এইদিনে আমার বাবা চোখ বুঁজেছিল। আবার তার এক বছর পর একইদিনে সে আমার কোলে ফিরে এসেছিল। ভেবে ভেবে আকুল হই। মনের কোণে প্রশ্ন জাগে; চূড়ান্ত কোন্ লক্ষ্য নিয়ে নানা রঙ্গের অংক কষে বিধাতা তার খেলায় মাতে?
খেলায় খেলায় কষ্ট বাড়ে, কষ্ট কমে অন্তরালে। আমার যে কোনটা হয় নিজেই তো বুঝিনা ছাই।
রাত এগারটায় সমস্ত আয়োজন শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন রান্না ঘরের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি, তখন ড্রইং রুম থেকে কিছু একটি ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাই। কিছুক্ষণ পর রান্না ঘরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে তুষার বলল, ‘মা, লোবত তা ভেংগে গেতে।’ শুনে আমার আনন্দ আর ধরে না। আনন্দটা কিসের বুঝতে পারি, বোঝাতে পারি না।
আজ তুষারের চতুর্থ জন্মদিন গেল। চতুর্থ সুখবার্ষিকী। সেই সাথে আমার পঞ্চম বেদনাবার্ষিকীও বটে। ছেলেটার বয়সের তুলনায় কথা একটু দেরীতে ফুটছে। ডাক্তার বলেছেন, ‘সমস্যা নাই, অনেক শিশুই দেরীতে কথা বলে।’ অনুষ্ঠানটি ছোটখাট করে করব করব করেও মোটামুটি বড় হয়ে গেল।
আমার বিয়ের আট বছর পর, বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন তুষার জন্মেছিল। বড় আশার এ জন্মদিনটি স্বামী সন্তানের সাথে উপভোগ করতে পারি না কখনোই। সুখের এই দিনটিতে যে কষ্টে কষ্টে লীন হয়ে যাই আমি।
বাসায় যে প্রৌঢ়া মহিলাটি আমাকে সারাদিন সাংসারিক কাজে সহযোগীতা করে, সে কিভাবে যেন জেনেছে আজ তুষারের জন্মদিন। যদিও ব্যাপারটি আমি গোপন রেখেছিলাম। সম্ভবত সেজন্যেই সে আজ একটি খেলনা মানুষ নিয়ে এসেছে। ছেলের বাবাও ছেলের জন্যে উপহার একটি এনেছিল গতকাল, সাইকেল। কিন্তু সাইকেল ফেলে এই সস্তা দামের রোবটটি কেন যে তার এত পছন্দ হয়ে গেল সে ই জানে। খুশী’র মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি আবার এটা আনতে গেলে কেন?’ সে ঠোঁট দু’টো অল্প নেড়ে বলেছিল, ‘আনলাম, পোলাপান মানুষ!’
শুনেছি বাবা শত কষ্টের মাঝেও আমার প্রথম জন্মদিনটির আয়োজন করেছিল। পরের জন্মদিন গুলোতে কেক কাটার মত আর্থিক সংগতি তার ছিল না। তাই বাকী জন্মদিনগুলো স্মরণ করা হলেও পালন করা হয়নি আর। সেই প্রথম জন্মদিনে তার দেয়া কাঠের পুতুলটি অক্ষত আছে আজো। এত আগের খেলনাটি এখনো অটুট থাকাতে আমার ভেতর আনন্দ জাগে না মোটেও। কষ্ট হয়। বাবাও যে ওটি দেখলে কষ্ট পেত তা বড় হয়ে বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।
আমাদের টিভি রুমে দাদার সচ্ছলতার শেষ প্রতীক হিসেবে একটি কারুকাজ করা বিশালাকৃতির শোকেস ছিল। তার নীচের দিক হতে ফুট তিনেক উপরে তাকের মত একটি বড়সড় খালি জায়গা ছিল। বাবা ওই খালি জায়গাটিতে আমাদের টিভিটা বসিয়েছিল। তবে এত বড় জায়গায় বার ইঞ্চি টিভিটাকে বড্ড বেমানান দেখাত। টেলিভিশন দেখতে বসলেই শোকেসে রাখা পুতুলটির দিকে বাবা আর আমার চোখগুলো ছুটে যেত বারবার। বাবা পরে টিভি সেটটি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছিল। বাবার কষ্টের পেছনের কারণ হচ্ছেন আমার মা।
মা খুব কড়া ধরনের মহিলা ছিলেন। এখানে যেতে পারবে ওখানে যেতে পারবে না, এটা খেতে পারবে ওটা খেতে পারবে না, চারপাশে সারি সারি নিয়ম কানুনের বেড়া। এরকম অনেক অনেক বিধি নিষেধের হাত থেকে সেই খেলনাটিও রেহাই পায়নি শেষ পর্যন্ত। সংসারের সবকিছুর প্রতিই মা বিশেষভাবে যত্নশীল ছিলেন। তেমনি খেলনাটির প্রতিও। সদা সতর্ক। তাই জন্যে, পুতুলটিকে মলিন বৈঠকখানার শোভা বর্ধনে শোকেসের গরাদে বন্দীত্ব বরণ করতে হয়েছিল কাঁচা বয়সেই। কখনো সখনো মায়ের অবর্তমানে বাবা পুতুলটি বার করে আমাকে সাথে নিয়ে খেলত। তবে সাবধানে থাকতে হত, যাতে পুতুলের গায়ে আঁচড় না লেগে যায়।
সেটি এখনো সযতনে রাখা আছে নীল মখমলে মুড়ে। তুষারের বাবাও অনেকটা আমার মায়ের মতই। সে একদিন ছেলেকে বলছিল, ‘আর কিচ্ছু আনব না কক্ষনো। বিকালে এত সুন্দর প্লেন আনলাম, রাতেই ভেঙ্গে ফেললি!’
কোন্ ভাঙ্গাতে তুষ্টি জাগে বুঝতে পারা ভার। খেলতে গিয়ে খেলনা ভাঙ্গা, নাকি না খেলাতে হৃদয় ভাঙ্গা? কে কিসেতে আনন্দ পায়, কান্না আসে কার?
এই মাঝরাতে নিজের কাছে নিজেকেই চোর চোর মনে হচ্ছিল। সন্তর্পনে আলমারী খুলে পুতুলটি বার করে বারান্দায় ফিরে আসি। প্রতি বছর এই বিশেষ দিনের এই সময়ে পুতুলটির সাথে আমি একা একা খেলি। স্বামী পুত্র কেউ জানে না এ খেলাটির মর্মকথা, শুধু জানি আমি। আর জানে সে, যে কিনা খেলেই চলে - খেলেই চলে, জীবন্ত সব খেলনা নিয়ে। ভাঙ্গা গড়ার খেলায় মেতে খুঁজতে থাকে - খুঁজতে থাকে; তার সৃষ্টির সার্থকতা।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন