বাংলাদেশ একদিকে যেমন ষড়ঋতুর দেশ তেমনি অন্যদিকে মৌসুমী ফলে ভরপুর দেশগুলোর অন্যতম। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফলের সমারোহ ঘটে এই দেশে। নানা জাতীয় মৌসুমী ফলে রয়েছে নানা ধরনের পুষ্টি। আমাদের দেশীয় ফলগুলো যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিতে সেরা।
খনিজ ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিদিন অন্তত একটি করে ফল খাওয়া প্রয়োজন, তা সে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা কিংবা আপেল, কমলা বা আঙ্গুরই হোক না কেন। বায়োমেডিকেল রিসার্চ গ্র“পের (খাদ্য ও পুষ্টি) ফেলো গবেষকদের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, দেশীয় মৌসুমী ফলে আছে ভিটামিন-এ, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন-সি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, খনিজ লবণ ইত্যাদি।এ ছাড়াও আছে কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থ, যেমন বায়োফাভোনয়েডস, ক্যারোটিনয়েডস ইত্যাদি; এগুলো শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। বার্ধক্য ও য়জনিত রোগ প্রতিরোধে এগুলো জরুরি। যেমন পারকিনসন্স ডিজিজ, আলজেইমার ডিজিজ ও হৃদযোগ প্রতিরোধে ফল বেশি কার্যকর। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো ফল থেকেই পাওয়া সম্ভব। কারণ রান্না করা খাবারে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
আমাদের দেশে গরমের সময় আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, তরমুজ, বাঙ্গি, কচি তাল, ডাবসহ বিভিন্ন ফল পাওয়া যায়। এখানে মূলত এই জাতীয় মৌসুমী ফলের বিভিন্ন পুষ্টি গুনাগুন সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া হলো।
আম
আম একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। আমাদের দেশে নানা জাতের আম পাওয়া যায়, যেমন লেংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, ফজলি, খিরসাপতি ইত্যাদি। কাঁচা আম ও পাকা আম দুই প্রকার আমই সমান পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। কাঁচা আমে ফাভোনয়েডস এর পরিমাণ বেশি, যা রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া পাকা আম ভিটামিন-এ তে ভরপুর।
পাকা আমের তুলনায় কাঁচা আমে ফাইবারের পরিমাণ বেশি, তাই ডায়াবেটিক মানুষের জন্য পাকা আমের চেয়ে কাঁচা আম বেশি উপকারী। কারণ কাঁচা আমের ফাইবার রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। কাঁচা আমের ক্যালরি মূল্য প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৪৪ কিলো ক্যালরি, কিন্তু পাকা আমের ক্যালরি মূল্য অনেক প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৯০ কিলো ক্যালরি।
তাই যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা এই আমের সময়টাতে পাকা আমর খেতে যতই ভালো লাগুক না কেন পরিমাণমতো খাওয়া উচিত এবং সেই সঙ্গে কাঁচা আম যেহেতু টক জাতীয় তাই ইচ্ছামতো খাওয়া যেতে পারে। কাঁচা আম ডাল দিয়ে অথবা ছোট বা বড় মাছ দিয়ে রান্না করে খাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও এই তীব্র গরমের সময়টাতে কাঁচা আমের টক-মিষ্টি ঠান্ডা ঠান্ডা জুস খেতে ভালোই লাগে।
কাঁঠাল
কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল হলেও এই সুস্বাদু ফলের পুষ্টি গুনাগুন সম্পর্কে অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই। পাকা কাঁঠালের ক্যালরি মূল্য প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৯০ কিলোক্যালরি এবং মোট খনিজ লবণের পরিমাণ প্রায় ০.৯। কাঁচা কাঁঠালের ফাইবারের পরিমাণ পাকা কাঁঠালের চেয়ে বেশ কয়েক গুণ বেশি। তাই ডায়াবেটিক মানুষের জন্য কাঁচা কাঁঠাল উপকারী। রক্তের চিনির মাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য কাঁচা কাঁঠালের জুড়ি নেই। কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে মাছ অথবা মাংসের মজাদার রেসিপি তৈরি করা যায় যা একদিকে যেমন মুখরোচক তেমনি অন্যদিকে স্বাস্থ্যকর। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পাকা কাঁঠালের কোয়া পরিমিত পরিমাণে খাওয়া ভালো।
লিচু
লিচু গ্রীষ্মকালীন একটি মিষ্টি, সুস্বাদু ও রসালো ফল। পুষ্টির দিক দিয়েও বেশ সরস। লিচুর আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হলেও ক্যালরি মূল্যও বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম লিচুর ক্যালরি মূল্য ৭৯ কিলোক্যালরি। লিচুর ক্যালরি মূল্য বেশি বলে ডায়াবেটিক মানুষের পরিমিতভাবে লিচু খাওয়া ভালো।
জাম
কালো জাম আমাদের দেশের একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল হলেও আজকাল এই ফলের ফলন প্রায় বিলুপ্তির পথে। অথচ অন্যান্য ফলের চেয়ে কালো জাম পুষ্টিতে অনবদ্য। কালো জামের রঞ্জক পদার্থ বার্ধক্যজনিত ক্ষয় পূরণে সাহায্য করে। জাম হজম শক্তি বৃদ্ধি করে, কালো জাম রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, তাই ডায়াবেটিক মানুষের কালো জামের মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে জাম খাওয়া দরকার।
তরমুজ
তরমুজ খনিজের উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে অন্যতম হলেও ভিটামিনেও ভরপুর। এ ছাড়া তরমুজে আর্দ্রতার পরিমাণও বেশি। তাই এই তীব্র গরমের সময় ঠান্ডা ঠান্ডা তরমুজের জুস অথবা কাটা তরমুজ খেতে পারলে তৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শরীরে পুষ্টির ঘাটতিও পূরণ হবে।
তালের শাঁস
কচি তাল বা তালের শাঁসে আর্দ্রতার অংশ বেশি। এ ছাড়াও কচি তালে আছে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবণ।
ডাবের পানি
ডাবের পানি খনিজ লবণে ভরপুর, বিশেষ করে সোডিয়াম, পটাসিয়ামের পরিমাণ বেশি, ভিটামিন-সি তে ভরপুর। ডাবের পানির ক্যালরি মূল্য তুলনামূলক অনেক কম যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা গরমের সময় কোক, ফান্টার পরিবর্তে ডাবের পানি খেতে পারেন, তাই বলে যথেচ্ছভাবে নয়।
পরিশিষ্ট কথা
শরীরটাকে সুস্থ স্বাভাবিক ও কর্মম রাখার জন্য আমাদের দৈনিক খাদ্য তালিকায় তেল-মসলা, ভাজা-পোড়া ইত্যাদি খাবারের অংশ কমিয়ে দেশীয় মৌসুমী ফল এবং টাটকা সবুজ শাকসবজি পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখা দরকার। এই টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল দেহে রোগ প্রতিরোধ মতা বৃদ্ধি করে দেহকে রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের জন্য একটি কথাই বার বার বলতে চাই, সুস্থ স্বাভাবিক থাকার জন্য প্রতিদিনই অন্তত একটি টক জাতীয় ফল খাওয়া দরকার কারণ টক ফল ভিটামিন-সি তে ভরপুর এবং টক ফল রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দিন